জিহাদ আর পরিযায়ী নয়, বরং এ রাজ্যের মাটিতে শিকড় গেড়ে তার বিস্তার ঘটছে গোটা দেশে।
১৪ বছর আগে খাস কলকাতার নাম জুড়েছিল আন্তর্জাতিক ইসলামিক জঙ্গি সংগঠন আল কায়দার সঙ্গে। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দারা কলকাতার বুকে এমন কয়েক জনের হদিশ পেয়েছিলেন, যাঁদের কাছে পাওয়া গিয়েছিল আল কায়দার নামে চাঁদার বই। তখনও বিশ্ব জুড়ে ইসলামিক জিহাদের ময়দানে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ওসামা বিন লাদেনের আল কায়দা। জিহাদের ময়দানে জন্ম হয়নি ইসলামিক স্টেট (আইএস)-এর। এর পর সাম্প্রতিক সময়ে এ রাজ্যের একাধিক তরুণ-তরুণী আইএস জঙ্গি যোগে গ্রেফতার হলেও, শনিবারের আগে পর্যন্ত এ রাজ্যে আল কায়দার সঙ্গে সরাসরি কোনও যোগ প্রকাশ্যে আসেনি।
কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের সেই সময়ের তদন্তে উঠে এসেছিল বাংলাদেশের রাজশাহির একটি ইসলামিক পাঠচক্রের কথা। জানা গিয়েছিল, তারই আড়ালে জিহাদের বীজ কলকাতাতেও বুনছিলেন কয়েক জন। এবং তাঁরা আল কায়দার মতাদর্শে বিশ্বাসী। সেই সময় এ রাজ্যে ‘জঙ্গি’ বলতে গোয়েন্দা থেকে শীর্ষ পুলিশ কর্তাদের ধারণা ছিল— তারা সব আমদানিকৃত। অর্থাৎ, পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর মদতে পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের পথ ঘুরে ঢুকে আসা কোনও নাশকতাকারী। সংগঠন হিসাবে তখন গোয়েন্দাদের তালিকায় শীর্ষে ছিল হরকত-উল-জিহাদ-ই-ইসলাম (বাংলাদেশ) বা হুজি (বি) এবং খাস পাকিস্তানি জঙ্গি গোষ্ঠী লস্কর-ই-তৈবার নাম। কিন্তু কখনই খাঁটি এ দেশি, বিশেষ করে এ রাজ্যের ‘হোম গ্রোন’ জিহাদের কথা সবাই অস্বীকার করে গিয়েছেন। কেন্দ্রীয় গোয়েন্দাদের অনেক গোপন নথিতেও এ রাজ্যকে উল্লেখ করা হয়েছে জঙ্গিদের ‘সেফ করিডর’ হিসাবে।
কিন্তু দৃশ্যটা অনেকটাই বদলে যায় ২০১৪ সালের খাগড়াগড় বিস্ফোরণ কাণ্ডের পরে। প্রথম দিকে বিষয়টি বাংলাদেশের একটি জঙ্গি সংগঠনের ‘গোপন ডেরা’ বলে রাজ্য পুলিশের একটি অংশ দাবি করে। কিন্তু ধীরে ধীরে জাতীয় তদন্তকারী সংস্থা এনআইএ-র হাত ধরে প্রকাশ্যে আসে সংগঠনের সম্পূর্ণ চেহারাটা। দেখা যায়, জিহাদ আর পরিযায়ী নয়, বরং এ রাজ্যের মাটিতেই শিকড় গেড়ে তার বিস্তার ঘটছে গোটা দেশে।
অনলাইনে প্রকাশিত বাংলায় লেখা আল কায়দার প্রচার পুস্তিকা।
আরও পড়ুন: মুর্শিদাবাদে এনআইএ-র জালে ৬ আল কায়দা জঙ্গি, কেরলে ধৃত ৩
আরও পড়ুন: রাজ্যে ধৃত জঙ্গিদের মধ্যে ইঞ্জিনিয়ারিং ছাত্র থেকে পরিযায়ী শ্রমিক
এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়েই অসম পুলিশের এক প্রাক্তন শীর্ষকর্তা যিনি দীর্ঘ দিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এসআইবি)-র যুগ্ম অধিকর্তা হিসাবে কলকাতায় কাজ করে গিয়েছেন, বলেন, ‘‘ভাল ভাবে দেখলে দেখা যায়, এ রাজ্যের সঙ্গে আল কায়দার যোগ যতটা পুরনো, তা বোধহয় ভারতের অন্য কোনও রাজ্যের নেই।” তাঁর ব্যাখ্যা, আটের দশকের শেষ দিক থেকে নয়ের দশক পর্যন্ত এক হাজারের কাছাকাছি বাংলাদেশি নাগরিক আল কায়দার ডাকে আফগানিস্তানে পাড়ি দিয়েছিলেন সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে মুজাহিদিন হিসাবে লড়াই করতে। তারাই ফিরে এসে আল কায়দার মতাদর্শে তৈরি করেন জামাতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ।
জেএমবি-র নিজস্ব নথিতেই সম্প্রতি প্রকাশ করা হয়েছে তাঁদের ২৪ জন মারা গিয়েছিলেন আফগানিস্তানে সোভিয়েত বাহিনীর সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে। এখনও আফগানিস্তানে তাঁদের সদস্যরা লড়াই করছেন। সেই জেএমবি-র শীর্ষ নেতা সইদুর রহমান থেকে রাজশাহির বাংলাভাই-সহ বেশ কয়েক জনের ফাঁসির পর সংগঠনের একটা বড় অংশ আশ্রয় নিয়েছিল এ বাংলায়। যা খাগড়াগড় বিস্ফোরণ পরবর্তী সময়ে স্পষ্ট। তাঁরা এ রাজ্যেই পাকাপাকি থেকে গিয়ে জিহাদের পর্ববর্তী ধাপে এগিয়েছেন যেখানে এ রাজ্যেকে সঙ্গে নিয়ে বৃহত্তর ইসলামিক বাংলাদেশের কথা বলা হয়েছে।
অসমের ওই পুলিশ কর্তাকে সমর্থন করছেন খাগড়াগড় তদন্তের দায়িত্বে থাকা এক পুলিশকর্তাও। তিনি বলেন, ‘‘খাগড়াগড় মডিউলে ধৃতরা স্পষ্টই স্বীকার করেছিলেন, তাঁরা তালিবানদের আদর্শে উদ্ধুদ্ধ। গ্লোবাল জিহাদ নিয়ে অসংখ্য নথি আমরা পেয়েছিলাম ওঁদের কাছে। আর সেই সময়েই আমরা বুঝতে পারছিলাম, এ রাজ্যের অনেকেই ওই জিহাদের পথে পা বাড়িয়েছেন।” এনআইএ-র ওই প্রাক্তন আইজি খাগড়াগড় পর্বের তদন্তের কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘‘আমরাই প্রথম রিপোর্ট দিই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রককে যে, জেএমবি আর বাংলাদেশের একটি জিহাদি সংগঠন নয়। ওই সংগঠনের রীতিমতো ভারতীয়করণ হয়েছে। আর তার জাল এ রাজ্যের বাসিন্দাদের হাত ধরে ছড়িয়েছে গোটা দেশে।”
গত কয়েক বছর ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় এ ভাবেই বাংলায় প্রচার চালাচ্ছে আল কায়দা।
এনআইএ-র ওই আধিকারিকের বক্তব্যের প্রমাণ পাওয়া যায় পরবর্তী ঘটনা প্রবাহে। খাগড়াগড়ের অধিকাংশ মূল মাথা পাকড়াও হওয়ার পরেও সামনে আসে জেএমবি-র নতুন মডিউলের। যারা বোধগয়ায় দলাই লামার উপর হামলা চালানোর পরিকল্পনা করেছিল। এঁরা কেউ বাংলাদেশের নন। সবাই এ রাজ্যের। জেএমবি-র অধরা শীর্ষ নেতৃত্ব বিভিন্ন সময়ে ধরা পড়ে এ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে। জানা যায়, খাগড়াগড় পরবর্তী সময়ে আদর্শগত ভাবে আড়াআড়ি ভাগ হয়ে গিয়েছে ওই জিহাদি সংগঠন। এক দল আইএস-পন্থী। তাঁদের অংশের নাম হয় নব্য জেএমবি। অন্য অংশ আঁকড়ে রয়েছেন আল কায়দার আদর্শকেই। নাম বদলে সেই অংশ এখন শুধু জামাতুল মুজাহিদিন। সঙ্গে বাংলাদেশ নেই। অর্থাৎ সংগঠনের ভারতীয়করণের সব ধাপই সম্পূর্ণ।
গোটা বিশ্ব জুড়ে ইসলামিক জিহাদের প্রতিটি কার্যকলাপের উপর নজর রাখা সাইট ‘ইনটেলিজেন্স গ্রুপ’ বারে বারেই আাল কায়দাকে একটি বিস্তীর্ণ ‘নেটওয়ার্ক’ বলে বর্ণনা করেছে। যারা নিজে থেকে উপস্থিত না থেকেও পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন সংগঠনকে নিজেদের ‘নেটওয়ার্ক’-এর অংশ করে নিতে পারে। জামাতুল মুজাহিদিনও এ রকমই আল কায়দার একটি নেটওয়ার্ক। যাদের একটি অংশ সরাসরি আফগানিস্তানে মুজাহিদ হিসাবে লড়াই করছে। অন্য অংশ আল কায়দার মতাদর্শে চলছে। কেন্দ্রীয় ভাবে ব্যবহার করছে আল কায়দার নেটওয়ার্ককে। তাই সাম্প্রতিক সময়ে জামাতুল মুজাহিদিনকে সামনে রেখেই বাংলায় প্রকাশিত হয়েছে আল কায়দার বিভিন্ন প্রচার পুস্তিকা, ম্যাগাজিন। এ বছরের গোড়াতেই প্রকাশিত হয়েছে ‘তাবরিয়াহ’ এবং ‘দাওয়াহ ইলাল্লাহ’ নামে দু’টি বাংলা ম্যাগাজিন। জিহাদের তাত্ত্বিক আলোচনা করা ওই অনলাইন ম্যাগাজিনে সরাসরি আল কায়দার সঙ্গে জামাতুল মুজাহিদিনের যোগাযোগের কথা বলা হয়েছে।
এই প্রচার এবং সাংগঠনিক বিস্তৃতির কাজে পিছিয়ে নেই বিশ্ব জুড়ে জিহাদের বাজারে আল কায়দার সবচেয়ে বড় ‘দুশমন’ আইএস-ও। তারা জেএমবি-র একটি অংশকে কাজে লাগিয়ে নব্য জেএমবি নামে বিস্তার ঘটাচ্ছে সংগঠনের। সাম্প্রতিক গোয়েন্দা তথ্য এবং এনআইএ-র দেওয়া তথ্য বলে, আইএস-এরও সমান ভাবে শিকড় গজিয়েছে এই বাংলায়। কৈখালির সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার মিখাইল থেকে শুরু করে বীরভূমের মুসা বা অতি সম্প্রতি বাংলাদেশে গ্রেফতার হুগলির প্রজ্ঞা দেবনাথ তারই উদাহরণ।
কিন্তু হঠাৎ করে এ রাজ্য কেন জিহাদের এত উর্বর জমি হয়ে উঠল? রাজ্য পুলিশের এক গোয়েন্দা কর্তার কথায়, ‘‘হঠাৎ উর্বর হয়ে ওঠেনি।” তাঁর ইঙ্গিত, বীজ বোনা হয়েছিল অনেক আগেই। দফায় দফায় জিহাদের প্রচার, মগজ ধোলাই একটা ধারাবাহিক পদ্ধতির মতোই হয়ে এসেছে এ রাজ্যে। বাংলার ভৌগলিক অবস্থান, এ রাজ্যের লাখ লাখ শ্রমিকের পরিযায়ী হিসাবে অন্য রাজ্যে কাজ করতে যাওয়া— সবটাই কাজ করছে অনুঘটক হিসাবে। সাম্প্রতিক সময়ে গোটা দেশে এবং রাজ্যেও ধর্মীয় মেরুকরণ, এনআরসি-সিএএ— এ সমস্তই জিহাদের জন্য তৈরি মাটিতে বীজ অঙ্কুরিত হতে সহায়ক হয়েছে। তাই শনিবারের আল কায়দা যোগ অপ্রত্যাশিত নয় বরং আরও এ রকম মডিউল প্রকাশ্যে আসা সময়ের অপেক্ষা বলে দাবি গোয়েন্দাদের একাংশের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy