Advertisement
E-Paper

আগুনের বর্ণমালায় লেখা নারীর বোধন

অধিকারের লড়াই নিয়েও মেয়েদের কড়া প্রশ্নের মুখে প্রসেনজিৎ-স্যর। সেলিমা বলে, এই যে দেশে ঠাকুর হিসেবে মেয়েদের পুজো হচ্ছে, তা হলে জ্যান্ত রূপে মেয়েদের সঙ্গে এত অন্যায় কেন?

স্কুল চত্বরে মেয়েদের প্রতিবাদ। (বাঁ দিক থেকে) বাবলি, সেলিমা, মেঘনা, মফিয়া।

স্কুল চত্বরে মেয়েদের প্রতিবাদ। (বাঁ দিক থেকে) বাবলি, সেলিমা, মেঘনা, মফিয়া। —নিজস্ব চিত্র।

ঋজু বসু

শেষ আপডেট: ০৯ অক্টোবর ২০২৪ ০৫:৫৪
Share
Save

প্রিয় লেখক? শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

প্রিয় বই? পরিণীতা।

সে কী, ওটা তো সেই বাল্যবিবাহেরই গল্প…

কিন্তু দেবদাসের মতো কষ্টের নয়, শেষটায় মিলই ভাল! টরটরিয়ে বলে সেলি, একুশের সেলিমা খাতুন। বাবার শিক্ষা ক্লাস ফোর। নবদ্বীপের কলেজ থেকে পরিবারের প্রথম স্নাতক সেলিমা সিনেমা দেখেনি, ‘পরিণীতা’ বইটাই পড়েছে!

মিনাপুরের স্কুলবাড়ি ঘেঁষে কাশের দোলা, বটতলার পুজো প্যান্ডেল থেকে ভেসে আসা গানের সুরেও কি মিশে থাকে গোপন প্রেমের গল্প? শুনে ঘাড় নাড়ে সেলিমা, বাবলি খাতুন, মেঘনা খাতুন, মফিয়া, খাদিজারা! মেঘনা বলে, “কলেজে গেছি, প্রাইমারি স্কুল টিচারি শেখার ডিএলএড করেছি! তবে ওই সবে গুরুত্ব দিইনি!” সেলি গম্ভীর: “কলেজে হয়তো মনে হল, ছেলেটা পড়াশোনায় ভাল, বেশ ভাল কথা বলে…কিন্তু ভাললাগা বোধ যদি জন্মেছে, নিজেই দাবিয়ে দিয়েছি! আব্বুকে বুঝিয়ে অনেক কষ্ট করে পড়তে আসা, ও সব আমার জন্য নয়!”

পূর্বস্থলীতে মিনাপুর নিম্ন বুনিয়াদি স্কুলের প্রাক্তনী কন্যাদের কে না চেনে এখানে! ওরাই স্থানীয় বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ কমিটির মুখ। স্কুলের প্রাক্তন প্রধানশিক্ষক হাজিসাহেব সোরবান আলি শেখ অভিভূত, “এ মেয়েরা গ্রামের সম্পদ! ওরা আর ইস্কুলের বর্তমান হেড স্যর প্রসেনজিৎ সরকার গ্রামগুলি পাল্টে দিয়েছে। মিনাপুর, যশপুর, গোকর্ণের মানুষ এখন ১৮র কমে মেয়ের বিয়ে দিতে ভয় পায়। এই মেয়েগুলি আর তাদের মাস্টারই এটা সম্ভব করেছে।”

“কার সঙ্গে প্রেম করতে হবে? কী ভাবে? সেই একটা ক্লাসও কিন্তু আমার মেয়েরা করেছে”, হেসে ওঠেন প্রসেনজিৎ-স্যর! মফিয়া, বাবলিরা বলে, “স্যর শিখিয়েছেন, যার সঙ্গে বিয়ে হবে সে যেন অন্তত খবরের কাগজটা ধরে পড়তে পারে! শিক্ষার মর্ম বোঝে!”

পুজোয় দল বেঁধে নবদ্বীপ, কালনায় এ মেয়েদের বিরিয়ানি-অভিযান। কিংবা জিরাটে, ব্যান্ডেলে প্যান্ডেল সফর। মেঘলা শারদ-আকাশে তাতেই মুক্তির নিশান। “তবে পুজোর হাতখরচে বাবার উপরে চাপ দেওয়া চলে না! আমরা পড়াই! নিজেদের সামর্থ্যটুকুও মাথায় রাখতে হয়”, বলে ওঠে মেঘনা, সেলিমা।

গ্রামের মেয়ে, বৌ, মুরুব্বিদের টেনে স্কুলবাড়িতে ইফতার, গান গেয়ে বসন্ত উৎসবের র‌্যালি, বিজয়া-সম্মিলনীর অনুষ্ঠান… পুরোভাগে নবীনা-ব্রিগেড। ওরাই ছোটদের ‘গুড টাচ, ব্যাড টাচ’ শেখায়! পাড়ায় পাড়ায় ওদের কমিটি মেম্বার। কারও ঘরে মেয়েকে পাত্রপক্ষ দেখতে এলে জেনে যাবে ঠিক। গ্রামগুলিতে ‘স্যানিটারি ন্যাপকিন’ শব্দটা শুনলে বৌরাও আর পুরুষদের সামনে লজ্জা পায় না। ইস্কুলেই ন্যাপকিন ব্যাঙ্ক। নামমাত্র দামে কিনে তা হাতে নিয়ে অসঙ্কোচে বাড়ি ফেরেন মহিলারা। মসজিদের হুজুর, মৌলবীরাও আজকাল স্যর বা তাঁর ছাত্রীদের দেখলে খোঁজ নেন, কোনও সমস্যা নেই তো! একটা প্রাথমিক স্কুল ঘিরেই নারী শিক্ষা, নারী স্বাস্থ্যে অধিকারের উৎসব।

অধিকারের লড়াই নিয়েও মেয়েদের কড়া প্রশ্নের মুখে প্রসেনজিৎ-স্যর। সেলিমা বলে, এই যে দেশে ঠাকুর হিসেবে মেয়েদের পুজো হচ্ছে, তা হলে জ্যান্ত রূপে মেয়েদের সঙ্গে এত অন্যায় কেন?

বাবলি: “হাসপাতালে দেখি, ছেলে হলেই রসগোল্লা খাওয়াবে! পর পর দুটো মেয়ে হলে বাবাওবেবিটার মুখ না দেখে ফিরে যায়।” শুনে ছায়া মেঘনা খাতুনের মুখে, “আমার বেস্ট ফ্রেন্ড লিপি মণ্ডলের তো কালনায় বড় ঘরে বিয়ে হয়েছিল...ওকে কেন মরতে হল! আর জিকরের মেয়েটার মতো ওরও বিচার পাওয়া বাকি!”

শুধু কি আর জি কর? কাছেই কাটোয়ায় একটি ছেলেকে প্রত্যাখ্যানের ‘অপরাধে’ ভরা বাসে খুন কিশোরীর খবরেও ছটফট করে মেয়েরা। সেলিমার বাড়ির পাশেই দুটো দিদির ১৩-১৪ বছরে বিয়ে হয়েছিল। চম্পাদির বরের অপমৃত্যু। শ্বশুরবাড়ি রাখেনি। তিনটি বাচ্চা কোলে বাপের বাড়ি ফিরেছে। আর কাশ্মীরাদিকে বর বেধড়ক মেরে অন্য মেয়েকে ঘরে তুলেছে। ওর সন্তা নদের কেড়ে নিয়েছে। পুলিশ শুধুই দর্শক। সেলি বলে, “অবাক লাগে এর পরেও কম বয়সে লোকে মেয়ের বিয়ে দেয়! খালি মনে হয়, দিদিগুলোর সঙ্গে অন্যায়ের বিরুদ্ধে যদি লড়তে পারতাম!”

বিচার, অন্যায়, লড়াই শব্দগুলোও নিষ্ঠুর নিম্নচাপের মতো ছেয়ে থাকে পূর্ব বর্ধমানের অখ্যাত গাঁয়ের আকাশে। আশ্বিনের বিকেল কালো হয়ে এলে মেয়েদের চোখে আতঙ্ক, “এই তো বন্যায় খোড়ে নদীর জল চাষজমিতে ঢুকে কত পাট পচে গেল! দু’বার করে ধান রুইতে হয়েছে। আবার বৃষ্টি হলে খাব কী?” সেলিমা তখন বলে, “তবে বাবলিদি, বৃষ্টি, বন্যার পরেও গ্রামটা কত বার ঘুরে দাঁড়াল! কিন্তু মেয়েদের সঙ্গে অন্যায়ের কিসে প্রতিকার? কম বয়সে একটা খারাপ বিয়ে হলে জীবনটাই নষ্ট! মেয়েদের জীবনে যে কত অসুর!”

নিম্নচাপের মেঘছায়াতেও ঝকমক করে অসুর বধের প্রত্যয়। এই তো সে-দিন! এ গ্রামেও ১৫-১৬তেই অরক্ষণীয়া ছিল মেয়েরা। এখন ২৬ বছরের মেঘনা বলছে, “১৩ বছরে বিয়ে হয়ে মাকে সারা জীবন হাঁড়ি ঠেলতে দেখেছি! জেদ চেপে গেছে, চাকরি না-পেলে বিয়ে করব না!” ২০২২-এর টেট পাশ করে বসে আছে কালনার কলেজে ভূগোল অনার্স মেঘনা। পুজোর পরে কি আসবে ইন্টারভিউয়ের ডাক? ২০২৩-এ সেলিমা, মফিয়ারাও টেট দিয়েছে। এইচএস পর্যন্ত কোনওমতে বিয়েটা ঠেকিয়ে সেলির ভয় ছিল, হাতে আর বেশি দিন নেই! তাই নবদ্বীপে বিএ পড়ার পাশাপাশিই বিদ্যানগরে ডিএলএডটা করে ফেলা! মফিয়া, বাবলিও তাই করেছে। বিয়ে নিয়ে নাতনির আপত্তিতে মফিয়ার সঙ্গে তার দাদুর কথা বন্ধ। সুরাতে হিরে পালিশ কারখানার শ্রমিক, মেঘনার দাদারও বোনের উপরে ঘোর অভিমান।

যশপুর গ্রামে সেলির বাবা থেমে থেমে বলেন, “যা পরিস্থিতি, ১০-১২ ক্লাসের পরে খরচা করে ছেলেমেয়েদের পড়ানোর ফায়দা দেখি না। মেয়েরা নিজের সন্তানকে শেখাতে পারলেই যথেষ্ট! সরকার তো চাকরিও দিতে পারে না!” সেলিমা ঠোঁট উল্টোয়, “দাদাকে তো কলেজে পড়িয়ে পুলিশ করতে চেয়েছিলে? কিন্তু আমি পুলিশ হতে চাইলেই সমস্যা।” “যা লম্বা তুই, পুলিশের চাকরিটা পেয়েই যাবি সেলি”, বলে ওঠে মফিয়া, বাবলি।

পর পর বৃষ্টিতে আর জি করের দিদিটার জন্য র‌্যালি ভেস্তে গেলে স্কুলবাড়িতে মিটিং বসে মেয়েদের। মেঘনা, সেলিমা বলে, “উচ্চ শিক্ষিতা ডাক্তারের যদি এমন হয়, আমরা তবে কোথায় পড়ে থাকব!” ঠিক হয়, বটতলায় মুদফফর দক্ষিণের প্যান্ডেলেও জড়ো হবে প্রতিরোধ কমিটির মেয়েরা। হাতে হাতে তৈরি প্রতিবাদী পোস্টার। আগুনের বর্ণমালায় লেখা নারীর বোধন।

(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)

Women Empowerment Women Education Durga Puja 2024

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:

Advertisement

আরও পড়ুন:

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy

{-- Slick slider script --}}