নদীর বুকে বসেছে বিদ্যুতের টাওয়ার।
টাওয়ারের গা ঘেঁসে ভেসেলটি পাশ করার সময়ে ছবি তোলার জন্য পর্যটকদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে গেল। নদীর বুকে দাঁড়িয়ে থাকা বিশাল টাওয়ারটিকে ক্যামেরাবন্দি করতে বড়দের হাত থেকে ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে ভেসেলের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে ছুট লাগাল ছোটরা। এ দিকে মাথার বোঁচকা নীচে নামিয়ে টাওয়ারকে উদ্দেশ্য করেই ‘জয় গঙ্গা মাইকি’ বলে দু’হাত জড়ো করে কপালে হাত ঠুকলেন হিন্দিভাষী মাঝবয়সী এক মহিলা। দিনের বেলায় টাওয়ারের তলায় লালবাতি দপদপ করে জ্বলতে দেখে এক তরুণীর কৌতুহলী প্রশ্ন, “সারাদিনই কী আলো জ্বলে।” সঙ্গী যুবক বিজ্ঞের মতো হাবভাব নিয়ে বোঝালেন, “কে আর রোজ রোজ মাঝনদীতে আলো নেভাতে আসবে।” উত্তর পেয়ে সন্তুষ্ট তরুণী। অন্ধকারে ডুবে থাকা সাগরকে আলোর বৃত্তে আনতে মুড়িগঙ্গা নদীর বুকে টাওয়ার বানিয়ে সাগরে বিদ্যুত্ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দ্বীপবাসীর প্রয়োজনের বাহক সেই টাওয়ারই এখন গঙ্গাসাগরে আসা পর্যটক, তীর্থযাত্রীদের কাছে দ্রষ্টব্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ায় মুড়িগঙ্গা নদীর ও পাশে কাকদ্বীপে বিদ্যুত্ এলেও এত দিন সাগরদ্বীপ ছিল বিদ্যুত্হীন। তাই সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে আঁধারে ডুব দিত সাগর। ভরসা বলতে ছিল, কেরোসিনের ল্যাম্প বা হ্যারিকেন। আর একটু সামর্থ্য থাকলে টালির বা ঘরের চালে দেখা মিলত একফালি সোলার প্লেটের। যদিও সাগরের ‘প্রাণকেন্দ্র’ হিসাবে পরিচিত রুদ্রনগর থেকে ডিজেলচালিত জেনারেটরের সাহায্যে অন্তত রাস্তার মোড়গুলিতে আলোর ব্যবস্থা করা হত। সেই সঙ্গে মোড়-লাগোয়া দু’একটি পরিবারেও জ্বলত ফ্লুরোসেন্টের দু’একটা বাল্ব। আবার কোথাও কোথাও নিজেদের চেষ্টায় জেনারেটর চালিয়ে আলোর ব্যবস্থা করা হত। তবে সেই ব্যবস্থা চলত রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত। তারপর নিঝুম অন্ধকারে তলিয়ে যেত গোটা সাগরদ্বীপ। গঙ্গাসাগরে বায়ুকল বসিয়েও কাছাকাছি চার-পাঁচটা গ্রামে বিদ্যুত্ সরবরাহের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু জোরালো বাতাস না মেলায় বছরের কিছুটা সময়ে বন্ধ থাকত বায়ু বিদ্যুত্ উত্পাদন। তার ফলে কোনও উদ্যোগই প্রকৃত প্রয়োজনকে মেটাতে পারছিল না। অবশেষে, সাগরদ্বীপের বাসিন্দাদের দীর্ঘদিনের দাবি মেনে বছর দু’য়েক আগে মুড়িগঙ্গা নদীর উপর তিনটে টাওয়ার বানিয়ে সাগরে বিদ্যুত্ নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বিদ্যুতের সুবিধা পেয়ে এখন আমূল বদলে গিয়েছে সাগরদ্বীপবাসীর জীবনযাত্রা।
সাগরদ্বীপে এখন পা রাখলে সেই দিন বদলের চিত্রটা খুব স্পষ্ট করে ধরা পড়ে। এখন কেরোসিনের কুপির ঠাঁই হয়ছে বাড়ির আঁস্তাকুড়ে। তার জায়গায় রাজত্ব করছে সিএফএল বা এলইডি আলো। খেটে খাওয়ার সংসারেও এখন দেখা মিলছে টেলিভিশনের। কেব্লের সংযোগ না থাকায় ডিটিএইচ কিনে সেই খামতি পুষিয়ে নিচ্ছেন অনেকে। এক সময় মোবাইলে চার্জ দিতে গেলেও দৌড়তে হত মোড়ে মোড়ে। শুধু মাত্র মোবাইলে চার্জ দেওয়াকে কেন্দ্র করে গজিয়ে উঠেছিল একাধিক দোকান। এখন তাদের ব্যবসা লাটে উঠলেও বাড়িতে বসে মোবাইল বা অন্যান্য বৈদ্যুতিন যন্ত্র চার্জ দিতে পেরে মুখে হাসি ফুটেছে সাগরবাসীর।
ভোল পাল্টেছে কপিলমুনির মন্দির-সংলগ্ন এলাকারও। এক সময়ে সন্ধে নামার সঙ্গে সঙ্গে এলাকায় নেমে আসত ভুতুড়ে আঁধার। দু’একটা সোলার পোস্টের আলো জানান দিত পথঘাটের। এখন রাস্তার দুপাশের ত্রিফলা বাতির ঝলমলে আলো দেখে সেই সব দিনগুলোকে যেন সুদূর অতীত বলে মনে হয়। এখন সাগরের সমুদ্র তটে বসে চুমুক দেওয়া যাবে ঠান্ডা পানীয়তে। ডালা-মালা দোকানের মালিক ও স্থানীয় বাসিন্দা সহদেব মাইতি জানালেন, আগে সন্ধে নামলেই দোকানের ঝাঁপ ফেলে বাড়ির পথ ধরতেন। এখন রাত ১০-১১টা পর্যন্ত নিশ্চিন্ত মনে দোকানদারি করতে অসুবিধা হচ্ছে না। আবার বাড়িতে বৈদ্যুতিন যন্ত্র বসিয়ে ব্যবসার জিনিপত্র তৈরি করে নিতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না পুষ্পা হালদারের।
বিদ্যুত্ সংযোগ আসায় সেজে উঠেছে কপিলমুনির মন্দির চত্বরও।
বিদ্যুতের সুবিধা মেলায় মন্দিরকে কেন্দ্র করে গজিয়ে উঠছে নতুন নতুন দোকানপাট, হোটেল, রেস্তোঁরা। যাত্রী স্বাচ্ছন্দের কথা মাথায় রেখে হোটেল মালিকদের কেউ কেউ রুমে এসি বসানোর কথাও ভাবছেন।
বিদ্যুতের সংযোগ নেওয়ার জন্য বাড়িতে বাড়িতে পড়ে গিয়েছে ওয়্যারিং করানোর ধুূম। বেড়েছে বৈদ্যুতিন যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার প্রবণতাও। তাই চাহিদা আছে জেনে স্থানীয় দোকানদারদের কেউ কেউ খুলে বসেছেন ইলেকট্রনিক্সের দোকান। স্থানীয় বাসিন্দা পেশায় ব্যবসায়ী সুব্রত জানা জানান, আগে তাঁর সেলাইয়ের দোকান ছিল। কিন্তু শরীর সায় না দেওয়ায় সেই দোকান প্রায় লাটে উঠতে বসেছিল। এখন চাহিদা আছে জেনে ধারদেনা করে খুলে বসেছেন ইলেকট্রনিক্সের দোকান। জানালেন, বিক্রিবাটা ভালই হচ্ছে। শারীরিক শ্রমও তেমন নেই।
সাগরের সব গ্রামে অবশ্য এখনও বিদ্যুত্ পৌঁছয়নি। তবে সেই কাজ যে পুরো মাত্রায় চলছে তা জানালেন সাগরের বিধায়ক বঙ্কিমচন্দ্র হাজরা। তিনি জানান, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বিদ্যুত্ বণ্টন সংস্থার সহায়তায় সাগরের ৪২টি গ্রামে বিদ্যুতায়ন প্রকল্পের কাজ শুরু হয়েছে। ওই প্রকল্পের জন্য প্রায় সাড়ে ৩৪ কোটি টাকা খরচ ধার্য করা হয়েছে।
সব মিলিয়ে বিদ্যুত্ জনজীবনে যে আমূল পরিবর্তন এনেছেস তা মানছেন সকলেই। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা থেকে শুরু করে ধান জমিতে জল দেওয়া-- সবেতেই বিদ্যুতের উপস্থিতিকে তাই সেলাম ঠুকছেন সাগরদ্বীপের বাসিন্দারা।
—নিজস্ব চিত্র।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy