ক্রিকেট মাঠের হেলমেট বড় ভরসা জওয়ানদেরও।—নিজস্ব চিত্র।
স্বরূপনগরের সীমান্তবর্তী এলাকায় গিয়ে দেখা গেল, ক্রিকেট খেলার হেলমেট মাথায় পরে টহল দিচ্ছেন জওয়ানেরা। কয়েক মাস আগে তাঁদের দেখা যেত, বাঁশের চটা দিয়ে তৈরি ঢাল নিয়ে ঘুরতে। কৌতুহলবশত প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া গেল, হেলমেট পরতে হচ্ছে কেন? আগে তো এমনটা দেখা যেত না। ঝাঁঝি দিয়ে বলে উঠলেন এক জওয়ান, “দেখছেন না দুষ্কৃতীদের কেমন বাড়বাড়ন্ত। বিএসএফকে গুলি করে মারছে। অথচ আমাদের গুলি চালানোর উপরে সাত রকম কড়াকড়ি।”
স্বরূপনগরের সীমান্তবর্তী এই এলাকায় কোনও কাঁটাতার নেই। বাংলাদেশি দুষ্কৃতীদের অবাধ পারাপার। এক সঙ্গে দু’তিনশো দুষ্কৃতী লাঠি, রাম দা, পিস্তল, বন্দুক নিয়ে গরু নিতে এ পারে আসে। ইট-পাটকেল ছোড়ে। বোমা ফাটায়। দা-কাটারি নিয়ে তেড়ে আসে। কর্তব্যরত ওই জওয়ান জানালেন, ভয়ানক সব দুষ্কৃতীদের রুখতে আধ কিলোমিটার সীমান্ত রাস্তায় টহলদার মাত্র দু’জন জওয়ান। কে কাকে বাধা দিতে যাবে! শীতের রাতে সমস্যা আরও বাড়ে। ঘন কুয়াশার মধ্যে কোন দিক থেকে যে অতর্কিতে হামলা আসবে, তা ঠাহর করতে পারেন না জওয়ানেরা। হাতে এলএমজি থাকলেও গুলি চালানোর উপরে যেহেতু নানা নিষেধাজ্ঞা, কাজেই প্রাণ বাঁচাতে মাথার হেলমেটই ভরসা।
বালতি-নিত্যানন্দকাটি পঞ্চায়েতের খলসি গ্রামের কুলতলা বিলের কাছে বৃহস্পতিবার ভোর রাতে বাংলাদেশি গরু পাচারকারীদের গুলিতে খুন হয়েছেন বিএসএফ জওয়ান রাশিকুল ইসলাম।
এ দিন তাঁর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, রাশিকুল বছর চারেক আগে চাকরি পেয়েছিলেন। বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান। খেলাধূলায় ছোট থেকেই ভাল ছিলেন। এলাকায় ভাল ছেলে হিসেবে সুনামও ছিল। পেশায় চাষি বাবা বজলুর রহমানের সামান্য জমি রয়েছে। ছেলে চাকরি পাওয়ার পরে সংসারে স্বাচ্ছন্দ্য ফেরে। একটি ছোট পাকাবাড়িও তোলা হয়। মাসখানেক আগে এক দিনের ছুটি নিয়ে রাশিকুল বাড়িতে এসেছিলেন। মাকে বলেছিলেন, পরের বার লম্বা ছুটি নিয়ে বাড়ি ফিরবেন। গল্পে গল্পে মাকে জানিয়েছিলেন, কী ভাবে সীমান্তে গরু পাচারকারীদের সঙ্গে লড়াই করতে হয়। সে সময় তাঁর মা মিনুয়ারা বিবি আশঙ্কা করেছিলেন। কিন্তু তাঁর সেই আশঙ্কা যে সত্যি হবে, ভাবেননি। সদ্য সন্তানহারা মায়ের মুখে কোনও কথা নেই। প্রতিবেশী সামাউল ইসলাম বলেন, “এই ভাবে একটি তরতাজা ছেলে হারিয়ে যাবে ভাবতে পারিনি।”
স্বরূপনগরের সংশ্লিষ্ট এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, গত চার-পাঁচ বছর ধরে বসিরহাটের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে গরু এবং মহিষ পাচার ব্যাপক হারে বেড়েছে। বাংলাদেশে গরু বিক্রি করে সেখান থেকে সোনার বিস্কুট এ পারে আনার প্রবণতাও বাড়ছে। সম্প্রতি বসিরহাট, হাসনাবাদ এবং হিঙ্গলগঞ্জ থানা এলাকা দিয়ে গরু পাচার খানিকটা কম হলেও স্বরূপনগর এবং বাদুড়িয়া সীমান্ত দিয়ে গরু পাচারে কোনও কমতি নেই। অভিযোগ, এক শ্রেণির রাজনৈতিক নেতা-কর্মীর দাপটে সীমান্ত এলাকায় দুষ্কৃতীরা কাউকে তোয়াক্কা করে না। ফলে বিভিন্ন সময়ে গরু পাচার নিয়ে কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন বা এ ওর ঘাড়ে দোষ চাপানো ছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলিকে আর কোনও ভূমিকায় দেখা যায় না। এক শ্রেণির পুলিশ অফিসার এমনকী, জওয়ানদেরও একাংশের প্রশয়ে দিন দিন পাচারকারীরা বেপরোয়া হয়ে উঠছে বলে অভিযোগ গ্রামের মানুষের।
চায়না প্রমাণিক, রীতা মণ্ডল, তরুণ বাছাড়দের মতো স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, ভোররাতে ঘুম ভেঙে গোলাগুলির শব্দ পেয়েছিলেন। তবে এ অভিজ্ঞতা তাঁদের নতুন নয়। কেউই বিশেষ গুরুত্ব দেননি। বাংলাদেশি গরু পাচারকারীদের সঙ্গে বিএসএফ যে প্রায়শই এঁটে ওঠে না, তা বিলক্ষণ জানেন সীমান্ত এলাকার মানুষ জন। ফলে গ্রামবাসীরাও দুষ্কৃতীদের প্রতিবাদ করতে সাহস পান না। জমির ফসল নষ্ট করে গরু নিয়ে যাওয়া হয় প্রায় প্রতি রাতেই। লক্ষ্মণ বিশ্বাস, বাসন্তী মণ্ডল, কণিকা পাত্র, নিমাই বাছাড়রা বলেন, “সীমান্তবাসীদের দুর্দশার কথা শোনার কেউ নেই। নেতারা গরু পাচার বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিলেও পাচার কখনওই বন্ধ হয় না। হয় তো পাচার পুরোপুরি বন্ধ হোক, তা কেউ চানই না।” সারা বছরই আতঙ্কে কাঁটা হয়ে থাকেন সীমান্তবর্তী এই সব এলাকার লোকজন। তাঁদের কথায়, “যারা বিএসএফ জওয়ানকে গুলি করে মারতে পারে, তাদের সঙ্গে আমরা পারব কী করে?” গ্রামের মানুষ নিজেদের অভিজ্ঞতায় দেখেছেন, পাচারকারীদের সমঝে চলেন জওয়ানেরাও।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy