ঝরে পড়া সেই বরফশিলা। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
বর্ষায় আকাশভাঙা বৃষ্টি তাঁরা দেখেন প্রায় ফি-বছরই। বসন্তে ছোট-বড় বরফের টুকরো হয়ে আস্ত আকাশটাকেই ভেঙে পড়তে দেখে বুধবার সন্ধ্যারাতে দিশাহারা হয়ে গেলেন বনগাঁর বাগদা-বয়রার বাসিন্দারা।
বৃষ্টিটা শুরু হয়েছিল সন্ধ্যাতেই। একটু পরেই শুরু হল ধুপধাপ, দুড়দাড় শব্দতাণ্ডব। ঘর ছেড়ে বেরোতেই চোখ কপালে উঠল বাগদা-বাসীর। একশো-দু’শো গ্রাম থেকে শুরু করে চার-পাঁচ কিলোগ্রামের বরফের টুকরো আর চাঙড়ে ঢেকে গিয়েছে উঠোন, শস্যের খেত, মাঠঘাট। গাছপালা, ঝোপঝাড় বরফে ছয়লাপ। আতঙ্ক আর বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গিয়েছেন মানুষজন। সীমান্ত-পারের গুলিগোলার মুখেও যাঁরা অকুতোভয়, সেই বিএসএফ জওয়ানেরাও মাথা বাঁচাতে ঢুকে পড়েন নিরাপদ ছাউনির তলায়।
এই তুষারপাতের সুবাদে বাংলার সীমান্ত-গ্রামে এক খণ্ড ভূস্বর্গ উঠে এসেছে বলে বিহ্বল হয়ে পড়ছেন কেউ কেউ। তবে সন্ধ্যারাতের অকাল-শিলাবৃষ্টিতে বিস্ময়বিমূঢ় বাসিন্দারা ক্ষয়ক্ষতিটা টের পেয়েছেন বৃহস্পতিবার সকালে। পাথরখণ্ডের মতো শিলার ঘায়ে বহু বাড়ির টালি-অ্যাসবেস্টসের চাল ভেঙে চুরচুর। ক্ষতি হয়েছে গাছপালা, খেতের শস্যেরও। রাতে মাথা বাঁচানোটাই ছিল আতঙ্কিত বাসিন্দাদের মূল লক্ষ্য। সকালে ক্ষয়ক্ষতির ব্যাপকতা তাঁদের দিশাহারা করে দেয়। সকালেই ত্রাণকার্য শুরু করে দেয় প্রশাসন। চলে আসেন বাগদার বিধায়ক তথা রাজ্যের মন্ত্রী উপেন বিশ্বাসও। বাগদার বিডিও মালবিকা খাটুয়া বলেন, “শিলাবৃষ্টিতে প্রায় পনেরো হাজার পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ক্ষতি হয়েছে চাষ-আবাদেরও। আপাতত ক্ষতিগ্রস্তদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দেওয়া হচ্ছে ত্রিপলও।”
শুধু বাগদা নয়, বুধবার সন্ধ্যা থেকে ঝড়বৃষ্টি হয় উত্তর ২৪ পরগনার অন্যান্য অঞ্চলেও। রাতে কলকাতার একাংশেও বৃষ্টি হয়। কিন্তু বাগদার বয়রা এলাকার এমন শিলাবৃষ্টির ঘটনা আর কোথাও ঘটেনি। কেন?
আবহবিদেরা বলছেন, শিলাবৃষ্টি খুব একটা বড় এলাকা জুড়ে হয় না। বরং স্থানীয় ভাবেই তার উপস্থিতি মালুম হয়। এ ক্ষেত্রেও তা-ই ঘটেছে। সাধারণত, গরম জলীয় বাষ্প বায়ুমণ্ডলের উপরিস্তরে উঠে ঘনীভূত হয়। ফলে জলীয় বাষ্প রূপান্তরিত হয় জলকণায়। কিন্তু বায়ুমণ্ডলের নীচ ও উপরিস্তরের তাপমাত্রার ফারাক যদি বেশি হয়, সে-ক্ষেত্রে জলীয় বাষ্প জমে বরফে পরিণত হয়ে যায়। সেই বরফই বৃষ্টিধারার মতো নেমে আসে। চলতি ভাষায় তারই নাম শিলাবৃষ্টি। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের বিজ্ঞানীদের মতে, সাধারণ ভাবে এমন ধরনের মেঘ-বরফ খুব বড় জায়গা জুড়ে তৈরি হয় না। তাই সেই বরফ-বর্ষণও একটি নির্দিষ্ট এলাকাতেই সীমাবদ্ধ থাকে। এক আবহবিজ্ঞানীর কথায়, “ওই বরফে রূপান্তরের প্রক্রিয়া যদি তড়িঘড়ি হয়, তা হলে সেই মেঘ তৈরি অল্প এলাকার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। এ ক্ষেত্রে তেমনটাই ঘটেছে বলে মনে হচ্ছে।”
ব্যতিক্রমও দেখা যায়। অনেকেই বলছেন, গত বছর গরমে উত্তর ২৪ পরগনা, হুগলি, কলকাতা জুড়ে প্রবল শিলাবৃষ্টি হয়েছিল। আবহবিদদের একাংশের ব্যাখ্যা, বজ্রগর্ভ মেঘ থেকে এই বরফ-মেঘ তৈরি হয়। সে-বার বজ্রগর্ভ মেঘটি ছিল বিরাট মাপের। তা ছাড়া বরফ ঘনীভূত হওয়ার প্রক্রিয়াটিও চলেছিল দীর্ঘ ক্ষণ ধরে। ঝোড়ো হাওয়ার গতিও শিলাবৃষ্টির দাপট বাড়াতে সাহায্য করেছিল।
অনেকেই অবশ্য বলছেন, এমন ঝোড়ো হাওয়া কিংবা শিলাবৃষ্টি সাধারণত মার্চের মাঝামাঝি থেকেই দেখা যায়। এ বার তা হলে ফেব্রুয়ারিতেই এই শিলাবৃষ্টি কেন?
এই ঘটনা যে প্রকৃতির সাধারণ নির্ঘণ্টের থেকে কিছু আগেই ঘটেছে, তা মেনে নিচ্ছে হাওয়া অফিসও। আলিপুর আবহাওয়া দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথের ব্যাখ্যা, গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গ এবং ওড়িশায় দু’টি আলাদা ঘূর্ণাবর্ত রয়েছে। বঙ্গোপসাগরে রয়েছে একটি উচ্চচাপ বলয়ও। সব মিলিয়ে সাগর থেকে জোলো হাওয়া ঠেলে ঢুকছে দক্ষিণবঙ্গের পরিমণ্ডলে। সেই জোলো হাওয়াই বায়ুমণ্ডলের উপরিস্তরে উঠে ঘনীভূত হচ্ছে। এবং সেই ঘনীভূত মেঘই এমন শিলাবৃষ্টির কারণ।
ঘূর্ণাবর্ত ও উচ্চচাপ বলয় এখন থাকবে। তার ফলে আগামী দিন দুয়েক ঝড়বৃষ্টির পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে, পূর্বাভাস আবহাওয়া দফতরের।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy