জমি দখল করে চলছে এই নির্মাণ, অভিযোগ উঠেছে জলট্যাঙ্কপাড়ায়।
সে দিন দাপাত জলদস্যু। আর আজ দাপাচ্ছে জমি মাফিয়া। এই দুয়ের ফ্রেমে যেন বন্দি হয়ে রয়েছে ডায়মন্ড হারবারের ইতিহাস।
পাঁচশো বছর আগে অবশ্য এই বন্দরনগরের নাম ছিল হাজিপুর। নুনগোলার কাছে হজযাত্রীদের জাহাজ নোঙর করা হত বলে ‘হাজিপুর’ নাম। তবে সব বাণিজ্য জাহাজই কলকাতার দিক থেকে মুড়িগঙ্গা বেয়ে সমুদ্রে পাড়ি দিত এখান দিয়েই। হুগলি নদীর পূর্ব তীরে ওত পেতে থাকত পর্তুগিজ জলদস্যুরা। বিশেষ করে মশলার জাহাজের ওপর তাদের নজর থাকত। তাদের তৈরি বেশ কিছু দুর্গের একটি এখনও রয়েছে ডায়মন্ড হারবারে। এখন সেখানে পিকনিক স্পট চালায় পুরসভা। দুটো লাইটহাউসও ছিল, এখন নদীর গর্ভে চলে গিয়েছে। রয়ে গিয়েছে পর্তুগিজদের দেওয়া নাম, ‘ডায়মন্ড হারবার’। ইংরেজরাও তা বাতিল করেনি।
সে যুগে হত জলে ডাকাতি। আর স্বাধীনতার পর থেকে শুরু হল জমি-ডাকাতি। পর্যটনের জন্য তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে জমির চাহিদা। পুর এলাকার মধ্যে কপাট হাট, নিউটাউন থেকে শুরু করে জেটিঘাট এবং তার পরেও পর্যন্ত প্রায় দেড় দু’কিলোমিটার এলাকায় সেচ দফতরের জমির উপর ল্যান্ড মাফিয়াদের চোখ পড়তে শুরু করেছে তখন থেকেই। প্রথমে রাস্তার ধারের জমির উপর এক চিলতে দোকান তৈরি করে তার পর পড়ে থাকা সেচের জমির উপর একটু একটু করে কংক্রিটের পিলার তুলে দিয়ে তার উপর পাকা দোকানপাট তৈরি করছেন এখানকার ব্যবসায়ীরা। এ ভাবেই কয়েকশো একর জমি চলে গিয়েছে বেআইনি দখলদারদের হাতে।
প্রশাসনের কাছে অন্যতম মাথাব্যথার কারণ এই জমি দখল। প্রতিনিয়ত সরকারি জমি বা রায়ত জমির উপর কব্জা করে চলেছে কোনও না কোনও দখলদার। কেবল ১১৭ নম্বর জাতীয় সড়কের দু’পাশেই নয়, শহরের বুক চিরে বেরিয়ে যাওয়া মগরাহাট খাল এবং পুর এলাকায় বিভিন্ন ছোট খাল-নালা দু’পাশের জমির উপরেও থাবা বসিয়েছে এই বেআইনি দখলদারেরা। মাঝেমাঝে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয় এসডিও দফতর থেকে। মামলাও দায়ের হয় দখলদারদের বিরুদ্ধে। কিন্তু শেষমেশ কোনও পরিবর্তন চোখে পড়ে না শহরবাসীর।
নুনগোলা পাড়ায় কবরস্থান-সংলগ্ন চার্চ।
কেন এই দশা? বিরোধীদের দাবি, দখলকারীদের মদত জোগাচ্ছে রাজনীতি। বিজেপির শহর সভাপতি মনোরঞ্জন কয়াল বলেন, “বাম আমলে দেখেছি, এই আমলেও দেখছি, ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল সামনে দখল ওঠাতে প্রচার চালাচ্ছে। পিছনে দখলকারীদের মদত দিচ্ছে।” ডায়মন্ড হারবার পুরসভার চেয়ারম্যান মীরা হালদারের দাবি, “আমরা নিরুপায়। কতবার জবরদখল সরাব? যতটা সম্ভব করেছি। জবরদখলকারীরা আমাদের বিরুদ্ধে মামলা করছেন।”
এই চাপান-উতোরের মধ্যেই শহরে বাম আমলে তৈরি আইনস্টাইন-স্ট্যালিন গ্রন্থাগারের জমি জবরদখল হয়ে চলেছে। গঙ্গার ধারের নিরিবিলি এলাকার আকর্ষণ বেশি হওয়ায় গজিয়ে উঠেছে অসংখ্য হোটেল। শহরের যাবতীয় কর্মকাণ্ড নদীর ধারের দেড়-দু’কিলোমিটার এলাকায় জমাট বেঁধেছে। সেই চাপে বেড়েছে জমির দাম। স্টেশন, বাস স্ট্যান্ড সংলগ্ন জমির বাজারদর সাড়ে তিন লক্ষ থেকে চার লক্ষ টাকা কাঠা।
কিন্তু জমি দখল, বেআইনি নির্মাণ টাকার অঙ্কে জমির দর যত বাড়াচ্ছে, ততই কমাচ্ছে নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য। শহরের প্রধান নালাগুলির উপর মাটি ফেলে বন্ধ করে দেওয়ায়, বর্ষা এলেই শুরু হচ্ছে নরকযন্ত্রণা। নয়ানজুলি বন্ধ হয়ে গিয়েছে বেআইনি নির্মাণে। শহরের বৃষ্টির জল খালে না পড়ে জমে থাকছে রাস্তায়। তাই বৃষ্টি হলেই ৬, ৭, ৯, ১০, ১২, ১৩, ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন জায়গা জলমগ্ন হয়ে পড়ে। রাস্তায় জমে থাকে ময়লা জল, আবর্জনা।
উত্তরে স্টেশন বাজার থেকে দক্ষিণে রাজার তালুক পর্যন্ত শহরের প্রায় ৫০০ মিটার লম্বা একটি নালা তৈরি হয়েছিল আশির দশকে। শহরের বেশ কিছু ওয়ার্ডের জল এখান দিয়েই বয়ে যেত। কিন্তু সংস্কার না করায় নালার নানা এলাকা জঞ্জালে মজে গিয়েছে। কোথাও বা দখল হয়ে পড়েছে। ফলে শহরের জল আর নালা দিয়ে রাজার তালুকের দিকে গড়ায় না। জমে থাকে দোরগোড়ায়। প্রায় বুজে গিয়েছে জলট্যাঙ্কপাড়া থেকে নুনগোলা পর্যন্ত খালটিও।
কপাট হাট থেকে মঞ্জিতা পর্যন্ত খালের উপরেও বেআইনি দখলে বন্ধ জলের গতি। কপাট হাট থেকে নতুনপোল পর্যন্ত খালেও একই অবস্থা। নাট্যকর্মী ও শিক্ষিকা মৌসুমী মিত্র বলেন, “এই শহরে জন্মেছি। যত বড় হয়েছি, দেখেছি জল জমার সমস্যা আরও বাড়ছে।”
জমিদস্যুদের জন্য শহর এখন জলবন্দি।
(চলবে)
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy