ধূসর নীল রঙের নতুন সাইকেলটা হাতে পেয়ে চোখের কোণে জল চিকচিক করছিল ওদের।
রোদ-বৃষ্টি মাথায় নিয়ে আর ঘণ্টা দেড়েকের রাস্তা পায়ে হেঁটে আর স্কুলে যেতে হবে না সুরশ্রী, সোমা, সুপর্ণাদের। অভাবের সংসারে বাবা-মায়ের সাধ্য ছিল না মেয়েকে সাইকেল কিনে দেওয়ার। এখন সরকারের কাছ থেকে সাইকেল পেয়ে আনন্দ আর ধরে না। কেউ কেউ তো আবার আগে থেকেই পাশের বাড়ির দিদির সাইকেলেই মহড়া দিয়ে নিয়েছিল। দিন কয়েক আগে সরকারি উদ্যোগে কাকদ্বীপের নবম শ্রেণির ছাত্রীদের সাইকেল বিতরণ অনুষ্ঠানে ধরা পড়ল এমনই সব ছবি।
বামানগর সুবালা হাইস্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী সুরশ্রী জানার বাড়ি কাকদ্বীপের বিশালাক্ষ্মীপুর গ্রামে। বাবা সুফলবাবু দিনমজুরি করেন। সামান্য আয়। এত দিন হেঁটে স্কুলে যেতে সুরশ্রীর ঘণ্টাখানেক সময় লেগে যেত। এ দিকে, বাড়ি থেকে উকিলেরহাটে টিউশন পড়তে যেতেও লেগে যেত এক ঘণ্টার বেশি সময়। একই অবস্থা কুমারপুর গ্রামের সুপর্ণা বেরা বা সোমা বেরাদের। কুমারপুর-জহরপুর কানাইলাল বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্রী সোমার বাড়ি থেকে স্কুল যেতে এক ঘণ্টারও বেশি সময় লেগে যায়। এখন হয় তো স্কুলে যাওয়াটা খানিকটা সহজ হল ওদের পক্ষে।
কাকদ্বীপ এলাকায় বেশিরভাগ মানুষই কৃষিজীবী। কেউ আবার কোনও রকমে দিনমজুরের কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। ছেলে-মেয়েদের স্কুলে পড়ানোর খরচ জোগাতেই হিমসিম খেতে হয় তাঁদের। তার উপর যাতায়াতের জন্য খরচ করা তাঁদের পক্ষে সম্ভব হয় না। অনেক সময়ে একা স্কুলে যেতে ভয় পায় পড়ুয়ারা। বিশেষ করে অনেক মেয়েই এই সব কারণে স্কুলে যাওয়া ছেড়ে দেয়। বেজপুকুর গ্রামের বাসিন্দা তথা এক ছাত্রীর অভিভাবক জাহাঙ্গির মোল্লার বক্তব্য, “চারদিকে যে ভাবে মেয়েদের উপর অত্যাচারের খবর শুনছি, তাতে মেয়েকে একা স্কুলে পাঠাতে ভয় লাগে। এ বার মেয়ের সাইকেলের পিছনে একজনকে বসিয়ে স্কুলে পাঠাতে পারব।”
রয়েছে পাকা রাস্তার সমস্যাও। গ্রামের রাস্তা কোথাও ইটের, কোথাও বা মাটির। সংস্কারের অভাবে অনেক ইটের রাস্তা চলার অযোগ্য হয়ে উঠেছে। বর্ষায় জল জমলে অনেক মাটির রাস্তায় কাদা ভেঙে যাতায়াত করতে হয়। সাইকেল বিতরণ অনুষ্ঠানে হাজির থাকা মেয়েরা জানাল, এরকম রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাতায়াতের ওই ধকলের পরে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে পড়াশোনা করার মতো মানসিক অবস্থা থাকে না।
বিভিন্ন সমীক্ষাতেও দেখা যাচ্ছে, পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার পরে অনেকটা সময় হেঁটে স্কুলে যাওয়ার কারণে অনেকেই স্কুলছুট হয়ে গিয়েছে। মেয়েদের মধ্যেই এই প্রবণতা বেশি। অনেক অভিভাবকই মনে করেন, এত দূরে মেয়েকে স্কুলে পাঠানোর কোনও মানে হয় না। স্কুল পাশ করে অর্থাভাবে উচ্চশিক্ষারও তেমন সুযোগ নেই যখন।
তবে এমন কিছু সরকারি প্রকল্প চালু হওয়ায় অনেকেই যে ফের স্কুলমুখী হচ্ছে, তা মনে করছেন শিক্ষকদের একাংশ। কাকদ্বীপ বীরেন্দ্র বিদ্যানিকেতনের প্রধান শিক্ষক দেবব্রত দাস বলেন, “নবম শ্রেণির ছাত্রীদের মধ্যে সাইকেল বিতরণ ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি আর্থিক অনুদান পাওয়ার সুযোগ অনেকটাই স্কুলমুখী করছে ছাত্রীদের। অভিভাবকেরাও উৎসাহিত হচ্ছেন।”
সাইকেল বিলি উপলক্ষে কাকদ্বীপ সুন্দরবন উন্নয়ন পষর্দের অফিসের পাশের মাঠে এক অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন সুন্দরবন উন্নয়ন পর্ষদের প্রতিমন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরা, কাকদ্বীপ পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি বুদ্ধদেব দাস, পাথরপ্রতিমার বিধায়ক সমীর জানা, নামখানা পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি শ্রীমন্ত মালি প্রমুখ। মন্ত্রী বলেন, “উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার ১৯টি ব্লকে ৩৩ হাজার ২০৯টি সাইকেল বিতরণের কাজ আজ থেকে শুরু হয়েছে। এতে মেয়েদের পড়াশোনায় সাহায্য হবে।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy