Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

খোলা আকাশের নীচেই চলছে ক্লাস, সমস্যায় পড়ুয়া-শিক্ষক

সকাল ১০টা। কচিকাঁচারা আসতে শুরু করেছে স্কুলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লাসঘরটি ভরে গেল। আর বসার জায়গা নেই। এরপরই খোঁজ পড়ল ত্রিপলের। খোলা আকাশের নীচে চারিদিকে জঙ্গলে ভরা পুকুর পাড়ে স্কুল ভবনের সামনেই একটি ফাঁকা জায়গায় ত্রিপল টাঙিয়ে শুরু হল ক্লাস। মিড ডে মিলের রাঁধুনি রান্নাঘরে মজুত চালের বস্তা পেতে দিলেন বসার জন্য। এমনভাবেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার মন্দিরবাজারের মুলদিয়া হালদার পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঠন পাঠন চলে।

দিলীপ নস্কর
ক্যানিং শেষ আপডেট: ১২ মার্চ ২০১৫ ০১:০৯
Share: Save:

সকাল ১০টা। কচিকাঁচারা আসতে শুরু করেছে স্কুলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ক্লাসঘরটি ভরে গেল। আর বসার জায়গা নেই। এরপরই খোঁজ পড়ল ত্রিপলের। খোলা আকাশের নীচে চারিদিকে জঙ্গলে ভরা পুকুর পাড়ে স্কুল ভবনের সামনেই একটি ফাঁকা জায়গায় ত্রিপল টাঙিয়ে শুরু হল ক্লাস। মিড ডে মিলের রাঁধুনি রান্নাঘরে মজুত চালের বস্তা পেতে দিলেন বসার জন্য। এমনভাবেই দক্ষিণ ২৪ পরগনার মন্দিরবাজারের মুলদিয়া হালদার পাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঠন পাঠন চলে।

প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলায় ডায়মন্ড হারবার, কাকদ্বীপ, বারুইপুর, আলিপুর, ক্যানিং এই ৫টি মহকুমা ৫১টি সার্কেলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সংখ্যা প্রায় ৩৭১৫টি। শিক্ষক শিক্ষিকার সংখ্যা প্রায় ১২০০ জন। ওই স্কুলগুলির মধ্যে বেশ কিছু স্কুলে ছাত্রছাত্রীর তুলনায় শিক্ষক কম। ভবনের অভাবে খোলা আকাশের নীচে বসে পড়াশোনা করতে হয়। অর্ধেকের বেশি স্কুলে পানীয় জল এবং শৌচাগার নেই। আর এই বেহাল পরিকাঠামোর মধ্যে স্কুল চালাতে নানা সমস্যার মুখে পড়তে হচ্ছে স্কুল কর্তৃপক্ষকে।

মন্দিরবাজারের মুলদিয়া হালদার পাড়া স্কুলটি ১৯৫৫ সালে সরকারি অনুমোদন পায়। ইটের গাঁথুনি ও টালির চাল দিয়ে পড়াশোনা শুরু হয়। বছর দেড়েক আগে বর্ষার সময় ঝড়ে ভবনটি ভেঙে পড়ে। এরপর এই স্কুলের জন্য সর্বশিক্ষা মিশন থেকে ১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা অনুমোদিত হয়। ওই টাকা দিয়ে স্কুলের পাশে একটি ভবন নির্মাণ করা হয়। ১১৫ জন ছাত্রছাত্রীকে নিয়ে ক্লাস শুরু হয়। পড়ুয়াদের স্কুলে বসে মিড ডে মিল খাওয়ার জায়গা নেই বলে বাড়ি থেকে টিফিন বক্স আনতে বলা হয়েছে। তাতে তারা খাওয়ার বাড়ি নিয়ে গিয়ে খেতে পারবে বলে জানায় স্কুল কর্তৃপক্ষ। তা ছাড়া খোলা আকাশের নীচে বাচ্চাদের খাওয়া ঠিক নয়। শুধু তাই নয় স্কুলের পানীয় জলের নলকুপ নেই। ফলে গাঁজিপাড়া থেকে জল আনতে হয়। যা স্কুল থেকে প্রায় এক কিলোমিটার দূরে। বাধ্য হয়ে পুকুরের জল দিয়েই মিড ডে মিলের খাওয়ার তৈরি করতে হচ্ছে। স্কুলে প্রধান শিক্ষক, একজন সহকারী শিক্ষক ও পার্শ্বশিক্ষক দিয়ে আপাতত কাজ চলছে।

তবে এমন সমস্যা শুধু এই স্কুলে, তা নয়। একই চিত্র দেখা গেল ওই এলাকারই কাদিপুকুর প্রাথমিক বিদ্যালয়েও। নিজস্ব ভবন না থাকায় বেশ কিছু দিন ধরে গ্রামের হাইস্কুলে পঠনপাঠন চালাতে হচ্ছে স্কুলটিকে। কিন্তু এতে নানারকম সমস্যাও দেখা যাচ্ছে। জেলার বহু স্কুলেরই এখন এই দশা। কোথাও শিক্ষক নেই। কোথাও আবার সরকারি সাহায্যের অভাবে পরিকাঠামো বেহাল। অভিভাবক এবং স্কুল কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, সমস্যা সমাধানের জন্য একাধিকবার প্রশাসনের কাছে জানিয়েও কোনও লাভ হচ্ছে না। ফলে কিছু কিছু স্কুলে পঠন-পাঠন কার্যত শিকেয় উঠেছে বলে অভিযোগ। মুলদিয়া হালদারপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গুরুদাস বৈদ্য বলেন, “এমন বেহাল পরিকাঠামোর মধ্যে বিদ্যালয়ের পঠনপাঠন চালাতে চরম সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। বিশেষ করে বর্ষায় সময় বেশি সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। গরম পড়ার আগে নতুন ভবন নির্মাণের অর্থ বরাদ্দ না হলে ফের গ্রীষ্মের প্রখর রোদের মধ্যে পঠন-পাঠন চালাতে হবে। সমস্ত বিষয় উর্দ্ধতন কর্তৃপক্ষকে একাধিকবার জানিয়েও কোনও সুরাহা হচ্ছে না।”

একই হাল ওই এলাকার চাঁদপুর চৈতন্যপুর পঞ্চায়েতের কাদিপুকুর প্রাথমিক স্কুলটির। কোনও পরিকাঠামো না থাকায় পঠন-পাঠন একেবারে শিকেয় উঠেছে। ১৯৪০ সালে স্কুলটি সরকারি অনুমোদন পায়। কিন্তু দীর্ঘদিন ধরে স্কুলটির কোনও সংস্কার হয় না। ফলে স্কুল ভবনটি বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ২০০৭ সালে সর্বশিক্ষা মিশন থেকে ১ লক্ষ ৭০ হাজার টাকা দিয়ে নতুন ভবন নির্মাণ করা হয়। কিন্তু তাও কোনওরকমে কাজ হয়েছে। কারণ বেশ কিছুদিন ভবন নির্মাণের কাজ চলার পর জমির মালিকানা নিয়ে আইনি জটে ভবন নির্মাণের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। এ দিকে পুরানো ভবনটি দিনে দিনে বিপজ্জনক হয়ে যাওয়ায় ২০১৪ সালে জুলাই মাসে সরকার থেকে ওই স্কুল ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়। তারপরে গ্রামেরই হা্ইস্কুলে ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু নানারকম সমস্যার জন্য প্রায় এক মাস ধরে স্কুলের পঠন পাঠন বন্ধ রাখতে হয়। শিক্ষা দফতরের হস্তক্ষেপে গত বছর সেপ্টম্বর মাস থেকে সকালে প্রাথমিক স্তরের ক্লাস শুরু হয়েছে।

রায়দিঘি টাঙ্গিপাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভবনটি বহুবছর আগে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু সময় মত সংস্কার না হওয়ায় দেওয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। চাঙড় খসে পড়ছে। ফলে বর্ষার সময় জল চুইয়ে ঢুকে পড়ছে শ্রেণি কক্ষের মধ্যে। তা ছাড়াও শ্রেণি কক্ষের মেঝেতে ইট পাতা না থাকায় বর্ষায় স্যাঁতসেতে হয়ে দুর্গন্ধ ছড়ায়। প্রধান শিক্ষক পরিতোষ বটব্যাল বলেন, “বিদ্যালয় ভবন সংস্কারের জন্য শিক্ষা দফতরের কাছে আবেদন করা হয়েছে। তা ছাড়া স্কুলের পাশে পুকুর থাকায় প্রাচীরের দরকার।” কাদিপুকুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক দূর্গাপদ ঘোষ বলেন, “বিদ্যালয়ের নিজস্ব ভবন না থাকায় কয়েক বছর আগে পর্যন্ত ছাত্রছাত্রী ছিল প্রায় ১০০ জন। বর্তমানে ঠেকেছে ৬৫ জন। হাইস্কুলে ক্লাস করতে গেলেও সমস্যা হচ্ছে। কারণ ছেলেমেয়েরা মিড ডে মিলের খাবার খেয়ে টেবিল বেঞ্চ নোংরা করে রাখে।” ভবন নির্মাণের জন্য সরকারি টাকার বালি পাথর, রড পড়ে নষ্ট হচ্ছে। চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে দুষ্কৃতীরা। তবুও প্রশাসনের কোনও হোলদেল নেই বলে অভিযোগ।

সমস্যা শুধু ওই এ ক’টি স্কুলে নয়। জেলায় বেশির ভাগ স্কুলেরই এমন দশা। এ প্রসঙ্গে জেলার প্রাথমিক শিক্ষা পর্ষদের চেয়ারম্যান জীবনকৃষ্ণ বৈরাগী বলেন, “কিছু কিছু স্কুলের ভবনের সমস্যা রয়েছে সেগুলি আস্তে আস্তে সমাধান করা হচ্ছে।” জেলা স্কুল পরিদর্শক (প্রাথমিক) উদয়ন ভৌমিক বলেন, “ওরা সর্বশিক্ষা মিশনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারে। তবুও খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

অন্য বিষয়গুলি:

dilip naskar canning southbengal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE