মায়া: গোল্ডিকে দুধ খাওয়ানো চলছে। পাশে স্নোয়ি। সোমবার, বারাসতে। ছবি: সুদীপ ঘোষ
মানুষ কয় প্রকার?
প্লাস্টিকের প্যাকেটের মুখ শক্ত করে বেঁধে ভিতরে সদ্যোজাত তিনটি কুকুরের ছানাকে রেখে নর্দমায় ফেলে গিয়েছিল কোনও মানুষ। সেই বাচ্চাগুলিকে ঘরে এনে ডাক্তার-বদ্যি ডেকে যত্ন করে বাঁচানোর চেষ্টা করে চলেছেন আরও কিছু মানুষই।
তবে দীর্ঘ সময়ে নোংরা, ঠান্ডা জলের মধ্যে পড়ে ছিল বাচ্চা তিনটি। হয়েছে শ্বাসকষ্টও। পলিথিনের মধ্যে একে অন্যের সঙ্গে আষ্টেপৃষ্ঠে আটকে থাকায় কারও সামনের পা দু’টি অসাড় হয়ে বেঁকে গিয়েছে, আতঙ্কে কারও বা দেখা দিয়েছে স্নায়ুরোগ। পশু চিকিৎসক দেখছেন। কিন্তু আপ্রাণ চেষ্টা করেও একটি কুকুরছানাকে বাঁচানো যায়নি।
কালীপুজো বলে বিশাল তোড়জোড় চলছিল বারাসতে। অন্য এলাকার মতোই ন’পাড়ার কালীবাড়ি রো়ডও ছিল জমজমাট। তার মধ্যে সকলের অলক্ষ্যেই রাস্তার পাশের বড় নর্দমায় বন্ধ পলিথিনের প্যাকেটে সদ্যোজাত কুকুরছানাগুলিকে ফেলে দিয়ে যায় কেউ। এমনিতেই নর্দমার মুখ ঢাকা থাকে বলে ভিতরের জিনিস সহজে নজরে আসে না। কিন্তু নর্দমার ভিতরে প্যাকেটটি নড়তে দেখে সন্দেহ হয় প্রতিমা ঘোষ নামে এক বাসিন্দার। কাছে গিয়ে শুনতে পান, প্যাকেটের ভিতর থেকে খুব আস্তে ‘কুঁই-কুঁই’ শব্দ আসছে। নর্দমা থেকে কোনওমতে প্যাকেটটি তুলে গিঁট খুলতেই দেখতে পান ছানাগুলিকে। তখন তাদের ন়ড়াচড়া করার শক্তিটুকুও নেই।
আরও পড়ুন: রোগী-মৃত্যু ঘিরে ‘তাণ্ডব’ বাইপাসের হাসপাতালে
সেখান থেকেই কুকুরছানাগুলিকে যত্ন করে বাড়িতে নিয়ে আসেন তিস্তা চট্টোপাধ্যায় নামে এক তরুণী। শুরু হয় ছানাগুলিকে বাঁচানোর চেষ্টা। প্রথমে হাল্কা গরম জলে স্নান করানো হয় তাদের। আতঙ্কে তখনও কাঁপছিল সারমেয় তিনটি। দুধ গরম করে চামচ দিয়ে কোলের ওমের মধ্যে রেখে খাওয়াতে থাকেন তিস্তার পিসি মৈত্রেয়ী। তিনি জানান, দুধ খেয়ে একটু বল পেতেই কোলের মধ্যে মাথা ঘষতে থাকে কুকুরছানারা।
এর পরেই চিকিৎসা শুরু হয়। দেখা যায়, একটি বাচ্চার সামনের পা দু’টো বেঁকে গিয়েছে। দাঁড়াতেই পারছে না সে। আর একটি বাচ্চার কাঁপুনি কিছুতেই থামছে না, হাঁটতেও পারছে না। মাথা ঘষে চলছে সে। তিস্তার বাবা জ্যোতিরিন্দ্রনাথ খাসনবিশ পশু চিকিৎসক। তিনি এসে বাচ্চা তিনটির চিকিৎসা শুরু করেন। ভাঙা পা দু’টি প্লাস্টার করে দেওয়া হয়। চলে ওষুধ খাওয়ানোও। এক দিন পরেও তারা ঠিকমতো সুস্থ না হওয়ায় ডেকে আনা হয় আরও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসককেও। কিন্তু এত করেও বাঁচানো যায়নি পা ভাঙা সারমেয়টিকে। তবে স্নায়ুরোগে আক্রান্ত বাচ্চাটি আস্তে আস্তে সুস্থ হচ্ছে, এখন মাথা তুলে দাঁড়াচ্ছে। মাঝেমধ্যে হাঁটছেও। অন্য ছানাটিও গুটিগুটি পায়ে হেঁটে বেড়াচ্ছে ঘরময়।
আরও পড়ুন: পরপর মেয়ে কেন? বধূকে শ্বাসরোধ করে খুনের চেষ্টা স্বামীর!
ওই বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, কুকুরছানাদের মশার উপদ্রব থেকে বাঁচাতে জ্বলছে ধূপ। নামকরণও হয়ে গিয়েছে তাদের। মৈত্রেয়ী জানান, অসুস্থ সোনালি রঙেরটির নাম গোল্ডি আর সাদা রঙের ছানাটির নাম স্নোয়ি। সারাদিন এখানে-ওখানে ছুটে বেড়াচ্ছে বলে স্নোয়ির ডাক নাম আবার তুড়তুড়ি। নাম ধরে ডাকতেই মৈত্রেয়ীর দিকে এগিয়ে আসছে তারা। দুধের বাটি দেখলে তো কথাই নেই। সঙ্গে সঙ্গে এক লাফে কোলে।
প্রতিবেশীরা জানালেন, পশুপ্রেমী বলেই এলাকায় পরিচিত খাসনবিশ পরিবার। রাস্তায় পশুপাখির বিপদ দেখলেই এগিয়ে যান তাঁরা। ওই বাড়িতে প্রতিদিন আলাদা করে দু’কিলোগ্রাম মাছ আসে। পাড়ার সাতটি বেড়াল দুপুর-রাতে এসে খায় সেখানে। জ্যোতিরিন্দ্রনাথ বলেন, ‘‘কেউ পশু না-ই ভালবাসতে পারেন, তা বলে ছোট্ট তিনটে বাচ্চাকে প্যাকেটে ভরে নর্দমায় ফেলে দেবে! এ কাজ তো কোনও পশু করতে পারে না, করবেও না। মানুষই করেছে। কিন্তু সে কেমন মানুষ?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy