গণনাকেন্দ্র থেকে বেরোচ্ছেন জয়ী দম্পতি শঙ্কর আঢ্য ও জ্যোৎস্না আঢ্য। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক।
একক এই প্রথম বনগাঁ পুরসভায় একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেল তৃণমূল। ২২টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৯টিতেই জয়ী হয়েছে তারা। গোবরডাঙা পুরসভার ১৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে তৃণমূল জয়ী হয়েছে ১৩টিতে। অশোকনগর-কল্যাণগড় পুরসভার ২৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ঘাসফুল শিবির জয়ী হয়েছে ১৮টিতে। ওই তিন পুরসভাতে অবশ্য ক্ষমতায় ছিল শাসক দলই। বনগাঁ ও গোবরডাঙায় আসনও বাড়িয়ে নিয়েছে তারা।
বনগাঁয় কংগ্রেস খাতা খুলতে পারলেও বাকি দু’টি পুরসভায় তাদের খালি হাতে ফিরতে হয়েছে। বিজেপি তিনটি পুরসভার একটিতেও কোনও আসন পায়নি। উত্তর ২৪ পরগনায় দলের জেলা সভাপতি তথা খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, ‘‘সিপিএম-সহ বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলিকে ওই তিনটি পুর এলাকার মানুষ ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। তবে আমাদের দায়িত্ব আরও বেড়ে গেল। মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে হবে।’’
২০০৫ সাল থেকে বনগাঁ পুরসভায় তৃণমূল ক্ষমতায় থাকলেও তাদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। কখনও কংগ্রেস, কখনও কংগ্রেস ও নির্দল কাউন্সিলরদের সমর্থন নিয়ে তাদের বোর্ড চালাতে হয়েছে। দলের ওই সাফল্যে স্বাভাবিক ভাবেই দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা বাঁধন ছাড়া উল্লাসে মেতে উঠেছেন। ভোটে বিরোধীরা শাসক দলের বিরুদ্ধে লাগাম ছাড়া সন্ত্রাস ও ছাপ্পার অভিযোগ তুলেছিল। তারপরেও ওই বিপুল সাফল্য তৃণমূল নেতৃত্বকে স্বস্তি দিয়েছে। এক তৃণমূল নেতাকে বলতে শোনা গেল, ‘‘বিরোধীরা সন্ত্রাসের অভিযোগ তোলায় কিছু মানুষের মধ্যে ভুল বার্তা গিয়েছে। তা উন্নয়ন দিয়ে আমাদের মোকাবিলা করতে হবে।’’
লোকসভার উপ নির্বাচনের নিরিখে তৃণমূল এখানে ১৭টি ওয়ার্ডে এগিয়ে ছিল। এ বার তারা আরও দু’টি আসন বাড়িয়ে নিয়েছে। তা ছাড়া, ১৮ নম্বর ওয়ার্ড থেকে জয়ী হওয়া নির্দল প্রার্থী মনোতোষ নাথ আদতে তৃণমূলেরই লোক। তিনি ৪০৪ ভোটের ব্যবধানে তৃণমূলের প্রার্থী সুফল হালদারকে পরাজিত করেছেন। ওয়ার্ডের তৃণমূল কর্মীদের বড় অংশ এ বার মনোতাষবাবুকেই দলের প্রার্থী হিসাবে চেয়েছিলেন। কিন্তু দল তাঁকে মনোনয়ন না দিয়ে কংগ্রেস থেকে তৃণমূলে আসা ওই ওয়ার্ডের বিদায়ী কাউন্সিলর সুফলবাবুকে প্রার্থী করে। স্থানীয় তৃণমূল কর্মীদের দাবি মেনে মনোতোষবাবু নির্দল হিসাবে দাঁড়িয়েছিলেন।
এ জন্য দল তাঁকে বহিষ্কার করার আগে মনোতোষবাবু ছিলেন বনগাঁ শহর তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক। এ দিন জয়ী হয়ে মনোতোষবাবু বলেন, ‘‘এই জয় ওয়ার্ডের সাধারণ মানুষ ও তৃণমূল কর্মীদের জয়।’’ ৫ নম্বর ওয়ার্ডে আবার তৃণমূল প্রার্থী রত্না ঘোষ পরাজিত হয়েছেন ৩১০ ভোটে। ২২টি ওয়ার্ডের মধ্যে এই একটি মাত্র আসনে জয়ী হয়েছে সিপিএম প্রার্থী মানবেন্দ্র কর্মকার। তৃণমূলের একটি সূত্র জানাচ্ছে, তাদেদর নিজেদের দলের অন্দরের কোন্দলের ফল ভুগতে হয়েছে এখানে।
সোমবার সকাল সবে ৯টা। বনগাঁ পুরসভার ৪ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ভোটের ফলেই তৃণমূল কর্মীরা মোটামুটি নিশ্চিত হয়ে যান, আশাতীত সাফল্যের মুখ দেখতে চলেছেন তাঁরা। কারণ, গত পুরভোটে ওই দু’টি আসনের একটিতেও তৃণমূল জয়লাভ করতে পারেনি। ৪ নম্বর ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছিলেন কংগ্রেসের তাপস মুখোপাধ্যায়। বাকি ওয়ার্ডটি ছিল সিপিএমের দখলে।
এরপরে সময় যত এগিয়েছে তৃণমূল প্রার্থীরা একের পর এক ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছেন। সব থেকে বেশি ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন শহর তৃণমূল সভাপতি শঙ্কর আঢ্য। তিনি ১ নম্বর ওয়ার্ড থেকে ৩০০৯ ভোটের ব্যবধানে জয়লাভ করেছেন। যদিও বিরোধীরা এখানে ছাপ্পার অভিযোগ তুলেছিলেন। লোকসভার উপ নির্বাচনে যে পাঁচটি ওয়ার্ডে (৬, ৭, ৮, ১৯, ২০) তৃণমূল প্রার্থী মমতা ঠাকুর পিছিয়ে ছিলেন, সেখানে এ বার তৃণমূল প্রার্থীরা জয়ী হয়েছেন। শাসক দলের গতবারের জয়ী কাউন্সিলরদের মধ্যে একমাত্র ২১ নম্বর ওয়ার্ডে পরাজিত হয়েছেন তরুণ সরকার। এখানে কংগ্রেস প্রার্থী সাধন দাস জয়ী হয়েছেন। তরুণবাবু বলেন, ‘‘বিজেপি ও সিপিএম ভোটে কংগ্রেসের দিকে চলে যাওয়ায় হেরে গিয়েছি।’’ গতবার কংগ্রেস ৫টি আসন পেয়েছিল। পরে কংগ্রেস কাউন্সিলরেরা তৃণমূলে যোগ দেন। ফলে কংগ্রেসের সংগঠন খুবই দুর্বল হয়ে গিয়েছিল বনগাঁয়।
একমাত্র জ্যোতিপ্রিয়বাবু ও শেষলগ্নে শতাব্দী রায় ছাড়া বনগাঁয় বড় কোনও নেতা-নেত্রী তৃণমূলের প্রচারে আসেননি। ফলে এই বিপুল সাফল্য স্থানীয় নেতৃত্বের বলেই কর্মীরা দাবি করছেন। মূলত প্রাক্তন বিধায়ক গোপাল শেঠ, বিধায়ক বিশ্বজিৎ দাস ও শঙ্করবাবুই ছিলেন এ বার প্রচারের মুখ। শঙ্করবাবু বলেন, ‘‘গত পাঁচ বছরে পুরসভার উন্নয়নের নিরিখে মানুষ ভোট দিয়েছেন।’’ বিশ্বজিৎবাবুর কথায়, ‘‘সন্ত্রাস দিয়ে এই বিপুল সাফল্য পাওয়া যায় না।’’
অশোকনগর-কল্যাণগড় পুর এলাকায় ঘরের দ্বন্দ্ব সামলে এ বারও তৃণমূল তাদের সাফল্য ধরে রেখেছে। গতবার তারা পেয়েছিল ২০টি ওয়ার্ড। এ বার দু’টি আসন কম। যদিও অশোকনগরের বিধায়ক তৃণমূলের ধীমান রায় বলেন, ‘‘গতবারের তুলনায় আসন দু’টি কম পেলেও মোট ভোট প্রাপ্তির দিক থেকে লোকসভার থেকেও আমরা এ বার কয়েক হাজার ভোট বেশি পেয়েছি।’’ প্রার্থী বাছাই নিয়ে প্রাথমিক অবস্থায় এখানে কর্মী-সমর্থকদের একাংশের মধ্যে ক্ষোভ ছিল। কিন্তু ভোটের ফলাফলে তার প্রভাব পড়েনি। কংগ্রেস ও বিজেপি এখানে খাতা খুলতে পারেনি। যদিও লোকসভার ভোটে বিজেপি প্রার্থী এখানে একটি আসনে এগিয়ে ছিলেন।
তৃণমূলের জয়ের আনন্দে গা ভাসালেন বনগাঁর তরুণী।
গোবরডাঙা পুরসভায় গতবার তৃণমূল পেয়েছিল ১১টি আসন। এ বার তা বেড়ে হয়েছে ১৩টি। যদিও লোকসভার উপনির্বাচনে তৃণমূল এগিয়ে ছিল ১৬টি ওয়ার্ডে। শুধুমাত্র ৯ নম্বরে তারা পরাজিত হয়েছিল। সেই তুলনায় ফল কিছুটা খারাপ হয়েছে শাসক দলের। ১৫ নম্বর ওয়ার্ডে নির্দল প্রার্থী হিসাবে জয়ী হয়েছেন গোবরডাঙা শহর যুব তৃণমূলের প্রাক্তন সভাপতি বিশ্বনাথ চক্রবর্তী। তিনি পরাজিত করেছেন তৃণমূলের প্রার্থী তথা বিদায়ী উপ পুরপ্রধান অসীম তরফদারকে। তৃণমূলের একটি প্রভাবশালী অংশের সমর্থন ছিল বিশ্বনাথবাবুর দিকে। সব থেকে বেশি ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন ৫ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল প্রার্থী তথা গোবরডাঙা শহর তৃণমূলের কার্যকরী সভাপতি শঙ্কর দত্ত। তিনি ১২৪৬ ভোটের ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন। ১৭ নম্বর ওয়ার্ডে পরাজিত হয়েছেন শাসক দলের বিদায়ী কাউন্সিলর গোবিন্দ মণ্ডল। ১৬ নম্বর ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছেন বাম সমর্থিত নির্দল প্রার্থী। ১০ নম্বর ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছে সিপিএম। তবে ৯ নম্বর ওয়ার্ডটি যেটি বহু বছর ধরে বামবিরোধীরা পাননি, সেটি এ বার দখল করেছে তৃণমূল।
এখানে গত বার কংগ্রেসের এক জন কাউন্সিলর ছিলেন এ বার একটিও আসন তারা পায়নি। বিজেপিও খাতা খুলতে পারেনি। শঙ্করবাবু বলেন, ‘‘এই জয় উন্নয়নের জয়। এলাকার আইন-শৃঙ্খলার ও শান্তির জয়।’’
জেলা বিজেপির সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব হালদার বলেন, ‘‘শাসক দলের সন্ত্রাস ও আমাদের নেতৃত্বের ব্যর্থতা এই ফলের কারণ। আমরা শাসক দলের অন্যায় কাজের বিষয়টি মানুষের মনের মধ্যে ঢোকাতে ব্যর্থ হয়েছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy