এ ভাবেই ভাঙচুর চলেছে বাড়িতে। ছবি: শান্তনু হালদার।
রাতের অন্ধকারে তখন শ’দুয়েক লোক হাতে শাবল, কুড়ুল, লাঠিসোঁটা নিয়ে রে রে করে হামলা চালাচ্ছে বাড়িতে। তাদের হুঙ্কার ভেসে আসছে দূর থেকে, ‘‘কোথায় গেল মেয়েটা? বের করে দে। ওর সর্বনাশ করে ছাড়ব।’’
ঘটনাচক্রে তার কিছু ক্ষণ আগেই রাতের খাওয়া সেরে দ্বাদশ শ্রেণি ছাত্রীটি মায়ের সঙ্গে হাওয়া খেতে বেরিয়েছিল বাড়ির পাশের মাঠে। ভয়ে আর বাড়িমুখো হওয়ার সাহস করেনি তারা।
সোমবার রাতের সেই ঘটনার কথা বলতে গিয়ে এখনও আতঙ্কিত কিশোরী। গুমার একটি স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ে সে। বাবার সঙ্গে সম্পর্ক নেই বহু দিন। মায়ের সঙ্গে মামা বাড়িতেই বড় হচ্ছে সে। মামার ছোটখাট ব্যবসা। মা কয়েকটি টিন-টালির ছাউনি দেওয়া ঘর ভাড়া দিয়ে সেই টাকায় কোনও মতে মানুষ করছেন একমাত্র মেয়েকে। আতঙ্কিত তিনিও।
কিন্তু কেন এমন হামলা?
গুমার খ্রিস্টান পাড়ায় ঘটনার সূত্রপাত সোমবার বিকেলে। মেয়েটি পুলিশকে জানিয়েছে, ওই দিন বিকেল ৫টা নাগাদ সে সাইকেল নিয়ে পড়তে বেরিয়েছিল। বাড়ির কাছেই বিদ্যাধরী খালের উপরে দাঁড়িয়ে ছিল দু’টি ছেলে। তাদের সে চিনত না বলেই দাবি মেয়েটির। সাইকেল নিয়ে সেতু পেরনোর সময়ে ছেলে দু’টি তার পিছু নেয় বলে অভিযোগ মেয়েটির। সঙ্গে উড়ে আসতে থাকে নানা অশালীন মন্তব্য।
খানিক ক্ষণ সহ্য করার পরে রুখে দাঁড়ায় মেয়েটি। ছেলে দু’টির সঙ্গে তার কথা কাটাকাটি শুরু হয়। চিৎকার-চেঁচামেচিতে মেয়ের বাড়ির লোকজনও চলে আসেন।
মঙ্গলবার অশোকনগর থানা চত্বরে দাঁড়িয়ে মেয়েটি বলে, ‘‘আমার বাড়ির লোকজন চলে আসার পরে দমে যায় ছেলে দু’টো। ওরা লিখিত ভাবে ক্ষমা চায়।’’
ঘটনাটি তখনকার মতো মিটে গিয়েছিল। মেয়েটিও পড়তে চলে যায়। অভিযোগ, সন্ধের দিকে দুই ছেলে ও তাদের পরিবার-পরিজন চড়াও হয় মেয়ের মামা বাড়িতে। সে সময়ে মেয়েটির মামাতো বোন-সহ কয়েক জনকে হামলাকারীরা মারধর করে বলে অভিযোগ।
কিছু ক্ষণের মধ্যেই গোটা ঘটনাটি অশোকনগর থানায় গিয়ে প্রসেনজিৎ বিশ্বাস নামে একটি ছেলে-সহ কয়েক জনের লিখিত অভিযোগ জানায় মেয়েটি ও তার পরিবার-পরিজন। একটি ছেলের পরিবারের তরফে পুলিশের কাছে তত ক্ষণে পাল্টা অভিযোগ দায়ের হয়ে গিয়েছে। সেখানে বলা হয়, সাইকেলে ধাক্কা লাগা নিয়ে মেয়েটির সঙ্গে তাদের গোলমালের সূত্রপাত। কিন্তু সামান্য ঘটনাকে বড় করে দেখানো হচ্ছে। মেয়ের বাড়ির লোকজন ছেলে দু’টিকে আটকে রেখে মারধর করেছে। মেয়েটিও এক জনের গালে দু’টি চড় মেরেছে। প্রসেনজিৎ পরে বারাসত হাসপাতালে ভর্তিও হয়।
গোলমালের খবর পেয়ে থানায় আসেন অশোনগর-কল্যাণগড় পুরসভার ২২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর সিদ্ধার্থ সরকার। ছেলে দু’টির বাড়ি শক্তিনগর এলাকায়, যা ওই ওয়ার্ডের অন্তর্গত। তিনি দু’পক্ষের সঙ্গে কথা বলেন। ঝামেলা মেটাতে মঙ্গলবার সকালে ফের দু’পক্ষকে নিয়ে আলোচনার আশ্বাস দেন।
কিন্তু ঘটনা সেখানেই থেমে থাকেনি।
অভিযোগ, রাত পৌনে ১২টা মেয়ের বাড়িতে চড়াও হয় শ’দুয়েক লোক। তাদের হাতে শাবল, কুডুল ছিল। মেয়েটির মামা বাড়ি এবং সংলগ্ন আরও তিন আত্মীয়ের বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর চালানো হয়। প্রবল গরমের মধ্যে মেয়েটি তখন মায়ের সঙ্গে পাশের মাঠে গিয়েছিল। গোলমাল বুঝে তারা গা ঢাকা দেন। অভিযোগ, চারটি বাড়ি ভাঙচুর চালিয়ে তছনছ করে দু’টি ছেলের পরিবার-পরিজন। ওই দলে বেশ কিছু মহিলাও ছিল। মেয়ের পরিবারের কয়েক জন মহিলা, শিশুকেও রেয়াত করা হয়নি। মারধর করা হয় তাদেরও।
একাদশ শ্রেণিতে পাঠরতা মেয়েটির মামাতো বোনের কথায়, ‘‘দিদিকে খুঁজছিল ওরা। না পেয়ে আমাকে ধরেই টানাটানি শুরু হয়। তুলে নিয়ে যাবে বলে হুমকি দেয়। আমার মাকে মারধর করা হয়।’’ বাড়ির ন’বছর ও সাত বছরের দুই খুদে সদস্য বলে, ‘‘আমরা ঘুমোচ্ছিলাম। ঘুম থেকে তুলে আমাদের চড়-থাপ্পর মারা হয়েছে।’’
মেয়ের মামা ছোট ব্যবসায়ী। মেয়ের মা কয়েক ঘর ভাড়া দিয়ে ওই টাকাতেই সংসার চালান। তাঁর অভিযোগ, ভাড়াটের উঠে যেতে বলে গিয়েছে হামলাকারীরা। তাঁদেরও এক দিনের মধ্যে এলাকা ছাড়ার হুমকি দেওয়া হয়েছে।
মেয়েটির কথায়, ‘‘আমি নিরাপত্তার অভাব বোধ করছি। ওরা শাসানি দিয়ে গিয়েছে, আমাকে রাস্তাঘাটে যেখানে দেখবে, তুলে নিয়ে গিয়ে আমার সর্বনাশ করে ছাড়বে। এরপরে এলাকায় কী করে থাকব, কে জানে!’’
রাতে স্থানীয় পঞ্চায়েত প্রধানের বাড়িতে যায় পরিবারটি। মঙ্গলবার সকালে ফের অশোকনগর থানার দ্বারস্থ হয় পরিবারটি। এ বার তৎপর হয় পুলিশ। সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার পর্যন্ত ৯ জনকে গ্রেফতার করেছে তারা। এ দিন অশোকনগর থানায় এসেছিলেন ডিএসপি (হেড কোয়ার্টার) দুর্বার বন্দ্যোপাধ্যায়। উত্তর ২৪ পরগনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ধৃতদের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানি, মারধর, কটূক্তি-সহ একাধিক ধারায় মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ। বাকি অভিযুক্তেরাও শীঘ্রই ধরা পড়বে।’’
মেয়েটির বাড়িতে হামলার তীব্র নিন্দা করেছেন তৃণমূল কাউন্সিলর সিদ্ধার্থবাবু। দোষীরা যাতে দ্রুত ধরা পড়ে, সেই দাবি করেছেন তাঁরা। পাশাপাশি তাঁর আরও বক্তব্য, নির্দোষ কাউকে যেন পুলিশ না ধরে। একই বক্তব্য, ওই এলাকার প্রাক্তন কাউন্সিলর সিপিএমের চিত্ত বিশ্বাস। স্থানীয় বিধায়ক ধীমান রায়ের বক্তব্য, ‘‘অত্যন্ত নিন্দনীয় ঘটনা। আইন আইনের পথে চলবে।’’
কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, প্রথম বার যখন মেয়ের পরিবার অশোকনগর থানায় গিয়েছিল, তখন যদি পুলিশ প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ করত, তা হলে রাতে হামলার সাহস পেত না কেউ। এ ক্ষেত্রে জেলা পুলিশের এক আধিকারিকের যুক্তি, মেয়েটি থানায় আসার আগেই একটি ছেলের পরিবারের তরফে মারধরের অভিযোগ হয়ে গিয়েছিল থানায়। এক কিশোর তত ক্ষণে হাসপাতালে ভর্তি। তার স্যালাইন চলছিল। সেই অবস্থায় পরিস্থিতি খতিয়ে না দেখে কাউকে আগেই গ্রেফতার করা কী ভাবে সম্ভব ছিল?
ছেলে দু’টির পরিবারের কারও সঙ্গে অবশ্য মঙ্গলবার যোগাযোগ করা যায়নি। বেশির ভাগ পুরুষই এলাকা ছাড়া।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy