চারদিনের মধ্যে তিন বার পুরপ্রশাসক বদল হয় গোবরডাঙায়। প্রতীকী ছবি
২০১০ সাল থেকে টানা দশ বছর গোবরডাঙা পুরসভায় ক্ষমতায় ছিল তৃণমূল। স্থানীয় রাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল সকলেই জানেন, এই সময়ে গোবরডাঙায় শাসক দলের ভরকেন্দ্র ছিল দত্ত পরিবারকে ঘিরে। পরিবারের সদস্য সুভাষ দত্ত দশ বছর পুরপ্রধান ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি এক বছরের বেশি সময় ধরে পুরপ্রশাসকের দায়িত্ব সামলেছেন। সুভাষের ভাই শঙ্কর ছিলেন কাউন্সিলর। শঙ্করের স্ত্রী বুলি বিদায়ী কাউন্সিলর। শঙ্করের আর এক দাদা রাজীব তৃণমূলের অবিভক্ত জেলার সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।
সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্ত সুর কাটে গত বছর বিধানসভা ভোটের পরে, অগস্ট মাসে পুরপ্রশাসকের পদ থেকে সুভাষকে সরিয়ে দেওয়ার সময় থেকে। পুরপ্রশাসক বদল নিয়েও বিস্তর নাটক দেখেছেন গোবরডাঙার মানুষ। চারদিনের মধ্যে তিন বার পুরপ্রশাসক বদল হয়। প্রথমে সুভাষের পরিবর্তে তুষারকান্তি ঘোষকে পুরপ্রশাসক করা হয়। সুভাষকে সরিয়ে দেওয়া তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের অনেকে মেনে নিতে পারেননি। তাঁরা পুরসভায় গিয়ে ক্ষোভ জানান। এরপরে নতুন সরকারি নির্দেশিকা প্রকাশিত হয়। সেখানে তুষারকান্তির পরিবর্তে তৎকালীন গোবরডাঙা শহর তৃণমূল সভাপতি সমীর নন্দীর নাম ঘোষণা করা হয়। সমীর পুরপ্রশাসকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কিন্তু ফের সরকারি নির্দেশ আসে। তাতে বলা হয়, সমীরের পরিবর্তে গোবরডাঙার নতুন পুরপ্রশাসক করা হল তুষারকান্তিকে। তখন থেকে এ বার ভোটে দাঁড়ানোর আগে পর্যন্ত তুষারকান্তি ওই দায়িত্ব সামলেছেন।
পুরসভার ভোটে দল এ বার সুভাষ ও বুলিকে প্রার্থী করেনি। দত্ত পরিবারের একমাত্র সদস্য হিসেবে দলের টিকিট পেয়েছেন শঙ্কর। তৃণমূল সূত্রের খবর, এ বার টিকিট বণ্টনে খুশি হতে পারেননি দত্ত পরিবারের কেউ কেউ। শহরবাসীর অভিজ্ঞতায়, তাঁরা তৃণমূলের মধ্যে আড়াআড়ি বিভাজন দেখছেন।
২০১৫ সালে পুরসভার ভোটে ১৭টি ওয়ার্ডের মধ্যে তৃণমূল পেয়েছিল ১৩টি। ২টি করে ওয়ার্ডে জয়ী হয়েছিলেন নির্দল এবং বাম প্রার্থীরা। কিন্তু গত লোকসভা ভোটে বিজেপি প্রার্থী শান্তনু ঠাকুর ১৫টি ওয়ার্ডে এগিয়ে ছিলেন। বিধানসভা ভোটে গাইঘাটা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী সুব্রত ঠাকুর ১৩টি ওয়ার্ডে এগিয়েছিলেন।
এ বার ভোটে নির্দল হয়ে দাঁড়ানো বিক্ষুব্ধ তৃণমূলের প্রার্থীরা কয়েকটি ওয়ার্ডে তৃণমূলকে বেগ দিতে পারে বলে মনে করছে রাজনৈতিক মহল। তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, ৬, ১২, ১৩, ১৫, ১১ নম্বর ওয়ার্ডে নির্দল প্রার্থীরা দাঁড়িয়েছেন। প্রাক্তন পুরপ্রধান সুভাষ তৃণমূল ছাড়ার কথা ঘোষণা করে ৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নির্দল হয়ে দাঁড়ান। পরে অবশ্য তৃণমূল নেতৃত্বের অনুরোধে প্রার্থিপদ প্রত্যাহার করেছেন। দলের হয়ে প্রচারও শুরু করেছেন।
যদিও গোবরডাঙার প্রভাবশালী এক তৃণমূল নেতার কথায়, ‘‘নির্দল প্রার্থীরা কেউ লিফলেট ছড়িয়ে প্রার্থী পদ প্রত্যাহার করার কথা বলেননি। ৬ নম্বর ওয়ার্ডেও গোপনে নির্দল প্রার্থীর হয়ে প্রচার চলছে।’’
এ বার প্রার্থী ঘোষণার পরে গোবরডাঙায় কর্মীদের ক্ষোভ-বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছিল। পথ অবরোধ হয়। দু’টি ওয়ার্ডে প্রার্থী অন্য ওয়ার্ডের বাসিন্দা। তা নিয়ে কর্মীদের অনেকে ক্ষুব্ধ।
তুষারকান্তি বলেন, ‘‘মনে হচ্ছে, দলের গোঁজ প্রার্থীদের দিকে তৃণমূলের কর্মীদের সমর্থন বেশি। আমার ওয়ার্ডে ফ্লেক্স, ব্যানার, পোস্টার ছেঁড়া হচ্ছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভয় দেখানো হচ্ছে। আমার আশঙ্কা, ভোটের দিন বুথ জ্যাম করে আমার বিরুদ্ধে ছাপ্পা ভোট দেওয়ার চেষ্টা হবে।’’ তুষারকান্তি কারও বিরুদ্ধে সরাসরি না বলেও তাঁর ইঙ্গিত দলেরই একাংশের বিরুদ্ধে বলে রাজনৈতিক মহলের অনুমান।
যদিও তৃণমূলের বনগাঁ সাংগঠনিক জেলার চেয়ারম্যান তথা প্রার্থী শঙ্কর বলেন, ‘‘আমাদের মধ্যে কোনও অনৈক্য নেই। ৬ ও ১২ নম্বর ওয়ার্ডের নির্দল প্রার্থীরা প্রার্থিপদ প্রত্যাহার করেছেন। বাকিদের বহিষ্কার করা হয়েছে। নির্দল প্রার্থীরা কোনও প্রভাব ফেলতে পারবেন না।’’
এ সবের মধ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রচার রয়েছে গোবরডাঙা গ্রামীণ হাসপাতালকে পূর্ণাঙ্গ হাসপাতাল হিসেবে তৈরি করতে না পারা নিয়ে। ২০১৪ সাল থেকে এখানে রোগী ভর্তি বন্ধ। এখন করোনা হাসপাতাল হিসেবে চালু আছে। দলের অন্তর্তদন্তে উঠে আসে, লোকসভা ও বিধানসভা ভোটে ভরাডুবির অন্যতম কারণ, পূর্ণাঙ্গ ভাবে হাসপাতালে চালু করতে না পারা। শহরবাসী জানিয়েছেন, নিকাশি এখানে বেহাল। অপরিকল্পিত ভাবে নালা তৈরি হয়েছে। জল জমে থাকে। যমুনা নদী, কঙ্কনা বাওড়, রত্না খাল সংস্কার হয়নি। ভারী বৃষ্টিতে বিস্তীর্ণ এলাকা জলমগ্ন হয়। সকলের বাড়িতে পানীয় জলের লাইন নেই। অনেক মানুষ জল কিনে খান। বাসিন্দারা এখানে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ ও মেডিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের দাবি তুলেছেন। সরকারি বাস পরিষেবা চালু করা, রাস্তা চওড়া করা ও প্লাস্টিকমুক্ত শহরের দাবি আছে।
তবে নাট্য ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের দাবি মেনে টাউন হল (অডিটোরিয়াম) নতুন করে তৈরি করা হয়েছে। এলাকায় শান্তি ফিরেছে। দুষ্কৃতীদের দৌরাত্ম্য নেই। রাস্তাঘাট পাকা হয়েছে। আলোর ব্যবস্থা হয়েছে। বিরোধীরা ভোটে সন্ত্রাসের আশঙ্কা করছে। ইতিমধ্যেই ব্যানার-পোস্টার ছেঁড়া, হুমকির অভিযোগ তুলেছে তারা।
বিজেপি নেতা তথা প্রার্থী আশিস বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘ভোটে যদি অবাধ ছাপ্পা না হয়, পুলিশ যদি নিরপেক্ষ থাকে, পুরবোর্ড তা হলে আমরাই দখল করব।’’ সিপিএম নেতা বাপি ভট্টাচার্য বলেন, ‘‘ছাপ্পা ভোট না হলে জয় আমাদের সুনিশ্চিত।’’ কংগ্রেস নেতা বরুণকুমার বসুর কথায়, ‘‘আমরা ৬টি ওয়ার্ডে প্রার্থী দিতাম। কিন্তু প্রার্থীদের ভয় দেখানোয় একটিমাত্র ওয়ার্ডে প্রার্থী দিতে পেরেছি।’’ সন্ত্রাসের অভিযোগ অস্বীকার করে শঙ্কর বলেন, ‘‘বিরোধীদের এখানে সংগঠন বলে কিছু নেই। পরাজয়ের ভয়ে আগে থেকে মিথ্যা দোষারোপ শুরু করেছে। ভোট শান্তিপূর্ণই হবে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy