মর্মান্তিক: এমন চিরকুটই লিখে রেখেছিল তুলসী (ইনসেটে)।
চিলেকোঠার দেওয়ালে হলুদ সেলোটেপ দিয়ে সাঁটা ছোট্ট চিরকুট— ‘প্রবলেম সলভড, গুড বাই এভরিওয়ান।’ পাশে হাসির ‘ইমোজি’। এমনই ‘সমাধান বার্তা’ সমেত এক কিশোরের ঝুলন্ত দেহ উদ্ধার হল। শুক্রবার, দেগঙ্গার সুকান্তপল্লি থেকে। পুলিশ জানায়, মৃত কিশোর তুলসী দাস (১৭) কার্তিকপুরের আদর্শ বিদ্যাপীঠের একাদশ শ্রেণির ছাত্র। প্রাথমিক তদন্তে পুলিশের দাবি, অবসাদের জেরে ওই কিশোর আত্মঘাতী হয়েছে।
এ দিন সকালে বাড়ির পাশে একটি সুপারি গাছে মায়ের শাড়িতে ফাঁস দেওয়া অবস্থায় তুলসীর ঝুলন্ত দেহটি উদ্ধার করেন বাড়ির লোক ও প্রতিবেশীরা। মেধাবী ছেলেটির মৃত্যুতে এলাকায় শোকের ছায়া নেমে আসে। এক প্রতিবেশী সুভাষ কর্মকার বলেন, ‘‘বয়স কম হলেও তুলসী পাড়ার যে কোনও সমস্যায় এগিয়ে আসত। সেই ছেলে যে এমন ভাবে জীবন থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেবে, বিশ্বাস করতে পারছি না।’’
প্রাথমিক তদন্তের পরে পুলিশ জানতে পেরেছে, সামনেই পরীক্ষা। পড়াশোনা ও বিভিন্ন চাপে মানসিক অবসাদে ভুগছিল ছেলেটি। পরিবারের তরফে দাবি, সম্প্রতি একটি মেয়ের সঙ্গেও সম্পর্কও হয় ওই ছাত্রের। এমনকী নেশার খপ্পরেও পড়েছিল সে। সেই সব অবসাদ থেকেই তুলসী ‘আত্মঘাতী’ হয়েছে বলে মনে করছে পুলিশ। এ দিন মৃতদেহটি উদ্ধার করে ময়না-তদন্তের জন্য বারাসত জেলা হাসপাতালে পাঠায় পুলিশ।
শুক্রবার তুলসীর স্কুলের সহপাঠীরা জানায়, বৃহস্পতিবারও স্কুলে গিয়েছিল সে। তবে বন্ধুদের কারও সঙ্গে তেমন কথা বলেনি। ক্লাসে আগাগোড়া মাথা নিচু করে বসে কাঁদছিল। জিজ্ঞাসা করায় জানিয়েছিল, মন খারাপ। শরীরও ভাল নেই। স্কুলের প্রধান শিক্ষক দেবদাস সেন বলেন, ‘‘তুলসী স্কুলে ভাল ছেলে বলেই পরিচিত ছিল। এমন যে কী করে করল আমরা কেউ বুঝে উঠতে পারছি না।’’
তার মৃতদেহ নিয়ে পরিজনেরা। শুক্রবার, দেগঙ্গায়।
দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় তুলসী। বাবা বীরবল দাস পেশায় ব্যবসায়ী। পরিবার সূত্রে খবর, দিন কয়েক ধরেই তুলসীর মধ্যে অস্বাভাবিক আচরণ দেখা যাচ্ছিল। দোতলার যে ঘরে সে থাকত সেখানে সব সময় এমনকী বেশি রাত পর্যন্তও মোবাইলে মগ্ন হয়ে থাকত। পড়াশোনা নষ্ট হচ্ছে বলে তিন দিন আগে ছেলের কাছ থেকে মোবাইলটি কেড়েও নেন বীরবলবাবু। এ দিন বীরবলবাবুর আক্ষেপ, ‘‘ছেলের পড়াশোনা নষ্ট হচ্ছিল বলে বকাঝকা করেছিলাম। তার জেরে যে এমন ভাবে সব শেষ হয়ে যাবে আঁচ করতেও পারিনি।’’
তুলসীর মা ভারতী দাস জানান, মোবাইল কেড়ে নেওয়ার পর থেকেই আরও চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল ছেলে। বুঝিয়েও লাভ হচ্ছিল না। তিনি বলেন, ‘‘গত কাল স্কুল থেকে নেশা করে বাড়িতে ফিরেছিল। দুপুরে খেতে বসে ওর বাবা বকাবকি করেছিল।’’ তিনি জানান, তার পর থেকে দোতলায় নিজের ঘরে একাই ছিল তুলসী। রাতে সেখানেই খাবার পৌঁছে দেন মা। সকালে ঘুম থেকে উঠে বাড়ির পাশের গাছে ছেলেকে ঝুলতে দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েন তিনি। তাঁকে বারাসত হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে।
পড়াশোনার চাপ, প্রেমে ব্যর্থতা— সেই একাকিত্ব থেকে মোবাইলে আসক্তি ও পরে অবসাদের জন্য অল্পবয়সীদের মধ্যে আত্মহত্যার প্রবণতা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন মনোরোগ চিকিৎসক গৌতম সাহা। তিনি বলেন, ‘‘পড়াশোনা নিয়ে প্রতিযোগিতার জন্য বন্ধুবান্ধবের সঙ্গেও নিবিড় সম্পর্ক তৈরি হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে বাবা-মাকেই ছেলেমেয়েদের বন্ধু হতে হবে। না হলেই মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়।’’ অবসাদ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসার পরামর্শও দিয়েছেন গৌতমবাবু।
—নিজস্ব চিত্র।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy