হাল ধরেছেন তিনি— যেমন জমিতে, তেমন সংসারেও। জমির চাষ-আবাদ সামলানো যে মূলত পুরুষদের কাজ, এই ধারণা ভেঙে দিয়েছেন গাইঘাটার শুভলতা তপাদার। আজ, শনিবার নারী দিবসেও তাঁর দিন কাটবে জমিতে। ইউটিউব চ্যানেল খুলে চাষের পাঠও দেন শুভলতা। তাঁর কথায়, ‘‘আমি চাই শিক্ষিত মহিলারাআরও বেশি করে চাষের কাজেএগিয়ে আসুন।’’
গাইঘাটার তিলি গ্রামে গেলেই শুভলতাকে দেখা যায় চাষের জমিতে। পরনে শাড়ি। শাড়ির উপরে পুরুষদের জামা পরা। মাথায় টোকা। সেটি গামছা দিয়ে বাঁধা। হাতে কাস্তে নিয়ে খেতে ধান কেটে চলেছেন। মাঝে মাঝে তাঁকে দেখা যায়, ট্রাক্টর চালিয়ে চাষের জন্য খেত প্রস্তুত করতে। বছর উনত্রিশের শুভলতার এ কাজে দক্ষতা দেখে অবাক হয়ে থমকে দাঁড়ান এলাকার প্রবীণ চাষিরাও! চাষবাস করে কোনও মহিলা সংসারের হাল ধরতে পারেন, তা এলাকায় কেউ ভাবতেইপারেননি আগে।
নদিয়ার শিমুরালিতে বাপের বাড়ি শুভলতার। সেখানে কেউ কখনও চাষবাসের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তিনি জানালেন, কয়েক বছর আগে তিলি এলাকার বাসিন্দা অমল তপাদারের সঙ্গে তাঁর বিয়ে হওয়ার পর থেকেই তাঁর জীবন বদলে যেতে শুরু করে। শ্বশুরবাড়িতে আসার পরে তাঁর কৃষিকাজে আগ্রহ তৈরি হয়। অমল চাষবাস করতেন। শুভলতার কথায়, ‘‘স্বামীর কাছ থেকেই চাষের পাঠ নেওয়া শুরু করি। কী ভাবে স্বামী খেতে ফসল ফলান, তা দেখতে দেখতে চাষবাসের প্রতি ভালবাসা জন্মায়। তারপরে ধীরে ধীরে এ নিয়ে পড়াশোনা শুরু করি। প্রথম দিকে ভুলভ্রান্তি হলে স্বামীই শুধরে দিতেন।’’
শুভলতা জানান, চাষবাস শুরু করার আরও একটি কারণ ছিল আর্থিক স্বচ্ছলতা না থাকা। ছেলে অংশু পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ে। শুভলতা বলেন, ‘‘স্বামীকে বলি, আমি চাষবাস সামলাব। উনি তাতে অন্য কাজ করার সুযোগ পাবেন।’’ অমল এখন কাঠের কাজ করেন। এতে আর্থিক স্বচ্ছলতাও বেড়েছে বলেও জানালেন শুভলতা।
এক বিঘে নিজেদের জমি ও দু’বিঘে জমি ভাগে নিয়ে শুভলতা এখন চাষ করছেন। তিনি জানালেন, ‘‘খেতে সর্ষে ছিল উঠে গিয়েছে। এখন ধান চাষ চলছে।’’ এরপরে পাট চাষ করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তাঁর কথায়, ‘‘গত বর্ষায় খেত জলে ডুবে যাওয়ায় আনাজ চাষ করতে পারিনি। ফলে আয় কিছুটা কমে গিয়েছে।’’
প্রথম দিকে গরু দিয়ে জমিতে লাঙল দিতেন শুভলতা। এখন ট্রাক্টর ব্যবহার করেন। গ্রামের বৌকে চাষবাস করতে দেখে অনেকে আগে হাসাহাসি করতেন বলে জানালেন শুভলতা। ‘বাঁকা কথাও’ শুনতে হয়েছে। শুভলতা বলেন, ‘‘সে সবে গুরুত্ব না দিয়ে নিজের কাজ করে গিয়েছি। এখন অবশ্য সকলেই সম্মানেরচোখে দেখেন।’’
আরও অনেক নারী যাতে এই কাজে যুক্ত হন, সে কারণেই ইউটিউবে চাষ শেখাচ্ছেন শুভলতা। জানালেন, তাঁকে দেখে অনেক মহিলা চাষে আগ্রহ দেখাচ্ছেন। নারী-পুরুষ অনেকেই এসে তাঁর কাছে চাষবাস নিয়ে পাঠ নিচ্ছেন। শুভলতার কথায়, ‘‘কী ভাবে ট্রাক্টর চালাতে হয়, ফসলে কী ভাবে রোগপোকা প্রতিরোধ করতে হয়, কখন কী সার দিতে হয়— সবই আমি শিখিয়ে দিই।’’ ‘শুভলতা কৃষি জীবন’ তাঁর ইউটিউব চ্যানেল আছে।
মাঠের মাঝে কাদা মাখা, ঘর্মাক্ত চেহারার শুভলতাই যেন নারী দিবসের প্রতীক মনে হয়!
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)