ত্রিপুরাসুন্দরী কালী। নিজস্ব চিত্র।
সুন্দরবন থেকে মা গিয়েছিলেন ত্রিপুরায়। সেই থেকেই ত্রিপুরা এবং সুন্দরবনের মানুষ শক্তিরূপিণী মা ত্রিপুরার আরাধনায় মেতে ওঠেন। সুন্দরবনের 'ত্রিপুরাসুন্দরী' এবং ত্রিপুরার 'ত্রিপুরেশ্বরী'র নাম একই সঙ্গে উচ্চারিত হয়। আজও সুন্দরবনের
মথুরাপুর থানার কৃষ্ণচন্দ্রপুরের ছত্রভোগের মা ত্রিপুরাসুন্দরীর মন্দিরে হাজার হাজার মানুষ ভিড় জমান।
আগে ত্রিপুরার রীতি মেনে দেবীর পুজো হলেও পরবর্তী কালে ব্রাহ্মণ্য মতেই পুজো শুরু হয়। কালী পুজোর দিন বিশেষ পুজোর আয়োজন হয় মন্দিরে। দেবীর চার হাত থাকলেও অনুপস্থিত শিব। এলাকার মানুষ বলেন, ত্রিপুরাসুন্দরীর ভৈরব হলেন স্থানীয় বড়াশি গ্রামের অম্বুলিঙ্গ শিব। ব্রিটিশ আমলে তৈরি হওয়া মন্দির ভেঙে পড়ার পর নতুন মন্দির তৈরির কাজ শুরু হয়।
ধর্মীয় রীতি বাদ দিলেও এই মন্দিরের বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে।
পণ্ডিতরা বলেন, 'কুব্জিকা তন্ত্র' অনুয়ায়ী ত্রিপুরা সুন্দরীর মন্দির ৪২টি শক্তি পীঠের একটি। এখানকার দেবীকে জ্যোতির্ময়ী রূপে বর্ননা করা হয়েছে। সে দিক থেকে বিচার করলে দেশের সতী পীঠগুলির চেয়েও অনেক প্রাচীন এই ত্রিপুরা সুন্দরীর মন্দির। ঐতিহাসিকদের মত,
সুলতান হুসেন শাহ যখন মসনদে, তখন বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে ভক্তি ভাবান্দোলন। সেই সময় দক্ষিণাঞ্চল, অধুনা সুন্দরবনের অধিপতি ছিলেন রামচন্দ্র খাঁ। শাসন কাজ চালানোর পাশাপাশি ছত্রভোগের ত্রিপুরাসুন্দরীর মন্দিরে মায়ের সেবাইত হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি।
চৈতন্য মহাপ্রভু নীলাচলে যাওয়ার পথে ভক্তদের নিয়ে কয়েকদিনের জন্য ছত্রভোগে এসে উপস্থিত হন বলেও শোনা যায়। মহাপ্রভুর চিন্তাধারা এবং ভাবে বিভোর হয়ে তাঁর কাছ থেকে দীক্ষা নিয়ে বৈষ্ণব হয়েছিলেন রামচন্দ্র খাঁ। কথিত আছে, চৈতন্যদেব ভক্তদের সঙ্গে নিয়ে ত্রিপুরাসুন্দরী মায়ের মন্দিরও দর্শন করেছিলেন। মন্দিরে পাঁঠা বলির রেওয়াজ থাকলেও রামচন্দ্র খাঁ বলি নিষিদ্ধ করেন। কিন্তু একদিন মন্দিরের সামনে কয়েকজন শিশু খেলতে খেলতে একটি পাঁঠাকে ধরে মন্দিরে আনতেই পাঁঠার মুণ্ড এবং ধড় নিমেষে আলাদা হয়ে যায় বলে জনশ্রুতি রয়েছে। সেই দৃশ্য দেখে এলাকার মানুষ ভয় পেলেও শাক্ত পণ্ডিতরা সেই সময় জানান, ত্রিপুরাসুন্দরী নিজেই বলি চাইছেন। ফের পাঁঠা বলি চালু করার নির্দেশ দেন রামচন্দ্র খাঁ। সেই থেকে এলাকায় ত্রিপুরাসুন্দরী মায়ের মাহত্ম্য আরও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।
এছাড়াও ত্রিপুরা রাজ্যের সর্বপ্রাচীন গ্রন্থ 'রাজমালা'তে উল্লেখ রয়েছে, পৌরাণিক কালে রাজা যযাতির পুত্র দ্রূহ্যু পালিয়ে এসে কপিলমুনির আশ্রমে আশ্রয় নিয়ে ছিলেন। তখন সুন্দরবন এলাকার নাম ছিল ত্রিবেগরাজ্য। পরবর্তী কালে তাঁরই বংশধর প্রতদ্রন কিরাত (অধুনা ত্রিপুরা রাজ্য) জয় করেন। ত্রিবেগ থেকেই কিরাত রাজ্য পরিচালনা শুরু করেন। তিনি প্রথম দেবী ত্রিপুরাসুন্দরীর পুজো শুরু করেছিলেন। পরে তাঁর বংশধর কলিন্দ দেবীর স্বপ্নাদেশ পেয়ে ত্রিবেগ রাজ্যের আদিগঙ্গা এবং ছত্রভোগ নদীর মাঝামাঝি এলাকায় ত্রিপুরাসুন্দরীর কাঠের বিগ্রহ-সহ মন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। কলিন্দের বেশ কয়েক প্রজন্ম পর বংশধররা কিরাত অর্থাৎ ত্রিপুরায় চলে যান। পিতৃপুরুষের আরাধ্য দেবীকে ত্রিপুরেশ্বরী নামে ত্রিপুরাতে প্রতিষ্ঠা করেন। ত্রিপুরা সুন্দরীর অনেক পরে ত্রিপুরেশ্বরীর পুজো শুরু হলেও এই দুই বিগ্রহকে একই দেবী বলেই মনে করা হয়।
ত্রিপুরা সুন্দরী মন্দির চত্বরের মাটির নীচ থেকে বহু মূর্তি ও প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী উদ্ধার হয়। যেগুলি পাল ও সেন যুগের নিদর্শন বলেই জানিয়েছেন গবেষকরা। এ বিষয়ে সুন্দরবনের প্রত্নতত্ত্ব ও ইতিহাসের গবেষক দেবীশংকর মিদ্যা জানান, "কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আশুতোষ মিউজিয়ামের পক্ষ থেকে অনুসন্ধান চালিয়ে বহু মূর্তি এবং প্রত্নতাত্ত্বিক সামগ্রী উদ্ধার হয়েছিল। সেগুলি রাজ্যের একাধিক মিউজিয়ামে রাখা রয়েছে। বর্তমান ত্রিপুরাসুন্দরী মন্দিরের মাটির নীচে রয়েছে পাল ও সেন যুগের প্রাচীন মন্দিরটি। খনন কাজ শুরু হলে প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শনগুলো সামনে আসবে।"
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy