দুর্ঘটনাস্থল দেখাচ্ছেন স্থানীয় দুই বাসিন্দা। ইনসেটে, রেললাইনে পড়ে রয়েছে এক তরুণের জুতো। ছবি: সুজিত দুয়ারি
স্কুল পড়ুয়াদের বড় অংশের মধ্যে ইদানীং বাড়ছে মোবাইল গেমে আসক্তি। সোমবার অশোকনগরে ট্রেনের ধাক্কায় দুই ছাত্রের মৃত্যুতে সেই ঘটনাই আরও একবার সামনে চলে এল। রেললাইনে বসে মোবাইল গেমে বুঁদ হয়ে থাকার জেরেই দুর্ঘটনা ঘটে বলে প্রাথমিক ভাবে জানা গিয়েছে। পড়ুয়াদের মধ্যে ক্রমবর্ধমান মোবাইল-আসক্তিতে উদ্বিগ্ন শিক্ষক শিক্ষিকা, অভিভাবকদের একাংশ।
শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কারও কারও মতে, করোনা পরিস্থিতিতে স্কুল বন্ধ। ফলে এক সঙ্গে গল্পগুজব, খেলাধুলো, হুড়োহুড়ি করতে পারছে না ছাত্রছাত্রীরা। বাড়িতে অভিভাবকদের সঙ্গে থাকতে থাকতে তাদের গ্রাস করছে একাকীত্ব। এর জেরেই অনেকে আরও বেশি করে আসক্ত হয়ে পড়ছে মোবাইল ফোনে।
ট্রেনের ধাক্কায় মৃত শিরুপন দে হাবড়ার প্রফুল্লনগর বিদ্যামন্দির স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণিত পড়ত। স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, বিজ্ঞান নিয়ে পড়ত সে। মেধাবী ছাত্র ছিল। তার এ ভাবে মৃত্যু মেনে নিতে পারছেন না স্কুল কর্তৃপক্ষ। প্রধান শিক্ষক সত্যজিৎ বিশ্বাস বলেন, “স্কুল বন্ধ থাকায় ছাত্রদের কাছ থেকে খেলার মাঠ হারিয়ে গিয়েছে। হুড়োহুড়ি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। পড়ুয়ারা ভিতর থেকে একা হয়ে যাচ্ছে। মানসিক ভাবে পঙ্গু হয়ে যাচ্ছে। একাকীত্ব থেকে মোবাইল গেমে আসক্ত হচ্ছে। অভিভাবকেরাও ছেলেমেয়েদের মোবাইল ফোন তুলে দিচ্ছেন। মনে রাখতে হবে, বন্ধুত্বের বিকল্প কখনও মোবাইল হতে পারে না।”
কয়েকদিন পরে স্কুল খুললে শিরুপনের স্মরণসভা হবে বলে জানিয়েছেন স্কুল কর্তৃপক্ষ। স্মরণসভায় মোবাইল গেম নিয়ে সচেতন করা হবে পড়ুয়াদের। পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষেও শিক্ষকেরা ছাত্রদের এ বিষয়ে সচেতন করবেন বলে জানানো হয়েছে।
শিক্ষক-শিক্ষিকারা জানালেন, স্কুল বন্ধ থাকায় বাড়িতে বদ্ধ অবস্থায় থাকতে থাকতে মানসিক অবসাদ গ্রাস করছে পড়ুয়াদের। অনলাইন ক্লাসের জন্যও এখন অনেকের হাতে উঠেছে মোবাইল। কিন্তু তাতে পড়াশোনা যেমন হচ্ছে, তেমনই গেম খেলতেও মোবাইল ব্যবহার করছে অনেকে। বাড়িতে পড়ুয়াদের আচার-ব্যবহারে পরিবর্তন এসেছে বলে জানাচ্ছেন অনেক অভিভাবক। উগ্র মানসিকতা তৈরি হয়েছে। বেশিরভাগই স্কুলের অনলাইন ক্লাসে অনুপস্থিত থাকছে। অভিভাবকেরা স্কুলে গিয়ে ছেলেমেয়েদের সমস্যার কথা নিয়মিত জানাচ্ছেন। অনেক ক্ষেত্রে স্কুল কর্তৃপক্ষ ছাত্রদের মানসিক চিকিৎসকের কাছে পাঠিয়ে তাকে কাউন্সেলিং করাচ্ছেন।
শিক্ষক-শিক্ষিকারা মনে করছেন, করোনা অতিমারির জেরে একটি প্রজন্মের পড়াশোনা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শুধু পিছিয়ে পড়া এলাকার নয়, আর্থিক ভাবে স্বচ্ছল পরিবারের বহু পড়ুয়ার পড়াশোনাতেও ক্ষতি হয়েছে। তার সঙ্গে বাড়ছে মোবাইল গেম খেলার আসক্তি।
বাগদার কোনিয়াড়া যাদবচন্দ্র হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক অনুপম সর্দার বলেন, “আমরা খবর পাই, পড়ুয়ারা স্কুলের অনলাইন ক্লাস না করে মোবাইলে গেম খেলে সময় নষ্ট করছে। গ্রামে গিয়ে তাদের হাতেনাতে ধরা হয়েছিল। গ্রামের অনেক মানুষই মোবাইল সম্পর্কে সচেতন নন। ফলে ছেলেমেয়েরা মোবাইলে কী করছে, তা তাঁরা জানতে পারেন না। সেই সুযোগটাই নেয় পড়ুয়াদের একাংশ।” অশোকনগর বয়েজ সেকেন্ডারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক সুশান্ত ঘোষের কথায়, “প্রায় দু’বছর স্কুল বন্ধ থাকায় পড়ুয়ারা বাড়িতে আবদ্ধ। অভিভাবকদের সঙ্গে থাকতে থাকতে তাদের মানসিক পরিবর্তন হচ্ছে। নিজেদের অনুভূতিগুলো কারও সঙ্গে ভাগ করে নিতে পারছে না। এর ফলেই তারা মোবাইল গেমে আসক্ত হচ্ছে।”
শিক্ষকদের বড় অংশ অবশ্য আশাবাদী, স্কুল খুললে আবার ধীরে ধীরে স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরবে ছাত্র-ছাত্রীরা।
বনগাঁ মহকুমা হাসপাতালের মনোরোগ বিশেষজ্ঞ শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী বলেন, ‘‘অতিমারির সময় স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় পড়ুয়ারা মোবাইলে দীর্ঘক্ষণ সময় কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। এই দুর্ঘটনা তারই অশনিসঙ্কেত। মোবাইল গেম মানুষের মনের ভিতর একটি বিকল্প বিশ্ব তৈরি করে দেয়, যেখান থেকে মস্তিষ্কের কিছু অংশ তীব্র ভাবে সক্রিয় হয়ে ওঠে। এর ফলে বাস্তব অবস্থা থেকে ছেলেমেয়েরা সরে যায়। এই প্রক্রিয়ায় অন্যমনস্কতা, খিটখিটে ভাব, অবসাদ, এমনকী, মৃত্যুচিন্তা পর্যন্ত আসতে পারে। অভিভাবকেরা খেয়াল রাখুন, সন্তান যাতে প্রয়োজনের অতিরিক্ত মোবাইল ফোন ব্যবহার না করে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy