জয়ন্তী দেব
ঘরের কাছে হাসপাতাল। ভ্যানে যেতে লাগে মিনিট পনেরো। কিন্তু রাতে পরিষেবা মেলে না সেখানে। দিনেও যে ঠিকঠাক মেলে, তা নয়। ফলে রাতবিরেতে চোদ্দো বছরের মেয়েটা যখন যন্ত্রণায় ছটফট করছে, তাকে গাড়ি ভাড়া করে ১৫ কিলোমিটার দূরের হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। সময় লেগে যায় অনেকটাই। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার মিনিট পাঁচেকের মধ্যে চিকিৎসকেরা জানিয়ে দেন, দেহে আর প্রাণ নেই। চিকিৎসকেরাই জানান, সাপের ছোবলে মৃত্যু হয়েছে নবম শ্রেণির ছাত্রী জয়ন্তী দেবের।
বাড়ির কাছে হাসপাতালে ঠিকঠাক পরিষেবা পাওয়া গেলে মেয়েটা প্রাণ হারাত না, বলছেন পরিবার-পরিজন।
জয়ন্তীর বাড়ি গোবরডাঙা পুরসভার ১১ নম্বর ওয়ার্ডের রঘুনাথপুর এলাকায়। স্থানীয় প্রীতিলতা গার্লস স্কুলে নবম শ্রেণিতে পড়ত সে। মঙ্গলবার রাত ১১টা নাগাদ যখন সাপে ছোবল মেরেছিল তাকে, প্রথমে বুঝতে পারেননি বাড়ির লোকজন।
কঙ্কনা বাওরের কাছে টালির বেড়ার ঘর জয়ন্তীদের। বাবা জ্যোতির্ময় বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন। দুই ভাইবোনের মধ্যে ছোট জয়ন্তী। পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, ঘুম ভেঙে হঠাৎ বুকে-পেটে জ্বালা করছে বলে সে। বাড়ির লোকজন ভেবেছিলেন, হয় তো খাওয়া-দাওয়ায় অনিয়মের জন্য অ্যাসিড হয়েছে। স্থানীয় চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যাওয়া হয় তাকে। তিনি ইঞ্জেকশন দিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দেন।
বাড়ি ফেরার পরে যন্ত্রণা আরও বাড়ে। বাড়ির লোকজন গাড়ি জোগাড় করে হাবড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যান জয়ন্তীকে। তখন রাত প্রায় সাড়ে ৩টে।
হাসপাতাল সুপার শঙ্করলাল ঘোষ বলেন, ‘‘আগে আনা হলে হয় তো মেয়েটিকে বাঁচানো যেত। সাপে কামড়ানো রোগীদের যত দ্রুত সম্ভব হাসপাতালে নিয়ে আসা উচিত। ওই কিশোরীর অবস্থা এতটাই খারাপ ছিল, এখানে আনার পাঁচ মিনিটের মধ্যে সে মারা যায়।’’ জয়ন্তীর দাদা পিন্টু বলেন, ‘‘রাতে আমাদের এলাকায় হাসপাতাল খোলা থাকে না। থাকলে ভ্যান বা টোটো করে বোনকে দ্রুত সেখানে নিয়ে যেতে পারতাম।’’
জয়ন্তীর মতো ঘটনা এলাকায় নতুন নয়, জানালেন অনেকেই। এলাকার হাসপাতালে পরিষেবা না মেলার ফল ভুগতে হয় অনেককে। গোবরডাঙা গ্রামীণ হাসপাতালের অন্তর্বিভাগ ২০১৪ সালের ৪ নভেম্বর থেকে বন্ধ। অতীতে এখানে রোগী ভর্তির ব্যবস্থা ছিল। ছোটখাটো অস্ত্রোপচার হত। দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতাল ভবন যন্ত্রপাতি পরিত্যক্ত অবস্থায় থেকে সব নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এলাকাবাসীর দাবি, নতুন করে হাসপাতালের পরিকাঠামোর তৈরির প্রয়োজন নেই। তা হলে কেন হাসপাতালটি পূর্ণাঙ্গ ভাবে চালু হবে না? এখন সপ্তাহের চার-পাঁচ দিন বহির্বিভাগে কয়েক ঘণ্টার জন্য একমাত্র চিকিৎসক রোগী দেখেন। শহরবাসীর দাবি, দিনের বেলা যেমন তেমন করে তবু চলে যায়। রাতে গোবরডাঙার মানুষ অসুস্থ হলে দিশাহারা বোধ করেন।
হাসপাতাল পূর্ণাঙ্গ ভাবে চালু করা নিয়ে এর আগে বিস্তর টালবাহানার সাক্ষী গোবরডাঙার মানুষ। বছর দু’য়েক আগে ব্যারাকপুরে প্রশাসনিক সভায় গোবরডাঙার পুরপ্রধান এই দাবি তুলেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে। তিনি পুরপ্রধান সুভাষ দত্তের মুখের উপরে বলে দেন, হাসপাতালটি চালু করার কোনও চিন্তাভাবনা নেই সরকারের। প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছিলেন সুভাষ। পরে অবশ্য পদে ফেরেন। কিন্তু এলাকায় দীর্ঘ দিন ধরে হাসপাতাল নিয়ে সমস্যার কথা নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে। দলমত নির্বিশেষে সে সময়ে আন্দোলনে নেমেছিলেন গোবরডাঙাবাসী। তাতে সামিল হয় তৃণমূলও। গত কয়েক দিন ধরে পূর্ণাঙ্গ ভাবে হাসপাতাল চালুর দাবিতে অনশন করছেন বিজেপির কিছু কর্মী-সমর্থক। তাঁদের কয়েকজন অসুস্থও হয়ে পড়েছেন।স্থানীয় যুবক অজয় মণ্ডল বলেন, ‘‘আর কবে মুখ্যমন্ত্রী আমাদের কথা শুনবেন। হাসপাতালটি চালু করতে কেন তিনি পদক্ষেপ করছেন না? আমরা গোবরডাঙার মানুষ অসহায় ভাবে দিন কাটাচ্ছি।’’
জয়ন্তীর পরিবার সূত্রে জানা গেল, হাবড়ায় যেতে গিয়ে তাঁদের বিস্তর কাঠখড় পোড়াতে হয়েছিল। গাড়ি জোগাড় করতেই কালঘাম ছোটে। একজনের বাড়ি গিয়ে তাঁকে ঘুম থেকে তুলে অনেক কাকুতি-মিনতি করে রাজি করাতে হয়। অনেক টাকাও খরচ হয়েছে। তারপরেও মেয়েকে বাঁচাতে না পেরে ভেঙে পড়েছে পরিবার।
হাসপাতাল পূর্ণাঙ্গ রূপে চালুর দাবিতে দীর্ঘ দিন ধরে আন্দোলন করছে গোরবডাঙা পৌর উন্নয়ন পরিষদ। পরিষদের সহ সভাপতি পবিত্রকুমার মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘হাসপাতাল বন্ধ থাকায় মানুষ মারা যাচ্ছেন। অসুবিধার মধ্যে পড়ছেন। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আমাদের দাবি, দ্রুত হাসপাতাল চালু করুন।’’ পুরপ্রধানের কথায়, ‘‘পুরসভার চারটি অ্যাম্বুল্যান্স রয়েছে। ফোন করলেই পাওয়া যায়। কিশোরীর পরিবার কেন করলেন না?’’ তাঁর বক্তব্য, হাসপাতাল নিয়ে বুধবার পুরমন্ত্রীর সঙ্গে আমাদের আলোচনা হয়েছে। খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, ‘‘হাসপাতালটি নিয়ে রাজ্য সরকার চিন্তা-ভাবনা করছে। শীঘ্রই রোগী ভর্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy