আগাছায় ঢেকেছে মর্গ।—নিজস্ব চিত্র।
হাসপাতালের লম্বা বারান্দাটা পেরিয়ে খোলা চাতাল—ব্যবধান বলতে এইটুকুই।
সাকুল্যে তিরিশ মিটারের ওই দূরত্বে, জানলার ভাঙা কাঁচ, কপাট ভাঙা হতশ্রী চেহারা নিয়ে হাসপাতালের লাশকাটা ঘর, সাবেক মর্গ।
৫২টি পচাগলা দেহ নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে যা উপচে উঠেছে। দমকা হাওয়া যেখান থেকে বয়ে আনছে পচা-গলা দেহেরে তীব্র দুর্গন্ধ। হাসপাতালের এক চিকিৎসকের কথা, ‘‘রোগীরা তো বটেই আশপাশের পড়শি মানুষজনও ওই গন্ধে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন।’’ দক্ষিণ ২৪ পরগনার ডায়মন্ড হারবার জেলা হাসপাতালের এটাই চেনা চেহারা।
হাসপাতালে শয্যা-সংখ্যা ৩০০। আর পাঁচটা জেলা সদর হাসপাতালের মতো লেগে রয়েছে রোগীর ভিড়। সঙ্গে রয়েছে সকাল থেকে বহির্বিভাগে নিত্য হাজার দেড়েক রোগীর আনাগোনা। নাকে কাপড় চেপেই সেই ভিড় সামলাচ্ছেন চিকিৎসকেরা।
মর্গের পাশেই সুভাষপল্লি। প্রায় দেড়শো পরিবারের বসত। লাগোয়া মহারাজপুর, হরিণডাঙার বাসিন্দাদের অনর্গল চলাচলও ওই পথে। খানিক দূরে ১১৭ নম্বর জাতীয় সড়কের দু’ধারে সার দিয়ে রয়েছে ছোট-বড় দোকান। দুর্গন্ধে জেরবার অবস্থা। সুভাষপল্লির এক বাসিন্দা বলছেন, ‘‘দীর্ঘ দিন ধরেই এই পরিস্থিতি। এখন যেন গন্ধটা কেমন গা-সওয়া হয়ে গিয়েছে। কিন্তু বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন আসতে চান না। অনেক সময়ে ছোটদের অন্যত্র পাঠিয়ে দিতে হয়।’’
প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ১৯৭৪ সালে ডায়মন্ড হারবার মহকুমা হাসপাতাল চালু হওয়ার দু’বছর পরে পুলিশ-মর্গ চালু হয়েছিল। ডায়মন্ড হারবার ও কাকদ্বীপ মহকুমার ১৪টি থানা ছাড়াও অন্য এলাকার কোনও রোগী ওই হাসপাতালে মারা গেলে ময়না-তদন্তের প্রয়োজন হলে ওই মর্গই ভরসা। ময়না-তদন্তের জন্য আছেন এক জন চিকিৎসক, সাহায্যকারী দু’জন ডোম। জেলা পুলিশের এক কর্তা বলছেন, ‘‘ময়না-তদন্তের পরেও দিনের পর দিন দেহগুলি পড়ে থাকছে ওই মর্গে। সমস্যাটা সেখানেই।’’ কেন?
ওই পুলিশ কর্তা জানান, অজ্ঞাতপরিচয়ের দেহ মর্গে পড়ে থাকছে দীর্ঘ দিন। নির্দিষ্ট সময়ের আগে তা দাহ করাও যাচ্ছে না। অনেক সময়ে গ্রামের দুঃস্থ মানুষজন অভাবের জেরে দেহ নিতে পারছেন না। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, অজ্ঞাতপরিচয়ের দেহ যদি সাত দিনের মধ্যে শনাক্ত না হয়, তা হলে ওই দেহ মাটিতে পুঁতে ফেলতে হবে। অথবা পুড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু নিয়ম তো কাগজে-কলমে। প্রতিটি দেহ সৎকারের জন্য ময়না-তদন্তের সহকারীদের দেওয়া হয় আড়াইশো টাকা। সেই টাকা থেকে পলিথিন, দড়ি কিনে দেহ প্যাকিং করে গাড়িতে করে নিয়ে যেতে হয় প্রায় ৫ কিলোমিটার দূরে, দলনঘাটা মোড়ে।
সেখানেই ৮ বাই ৮ ফুট গভীর গর্ত খুঁড়ে দেহ মাটি চাপা দিতে হয়। তবে দেহ গাড়িতে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশের সাহায্যে লাগে। কারণ, রাস্তায় যাওয়ার সময়ে এতটাই দুর্গন্ধ ছড়ায়, পথ চলতি মানুষ অনেক সময়ে অশান্তি বাধান। এই সমস্ত কাজের তদারকির দায়িত্ব পুরসভা, পুলিশ ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। কিন্তু হুঁশ নেই কারও।
হাসপাতাল ও পুরসভা সূত্রে খবর, গত ৩৯ বছরের ওই মর্গে কোন সংস্কার হয়নি। ফলে মর্গের চেহারা অনেকটা পরিত্যক্ত ভবনের মতো। অনেক সময়ে মর্গের সামনে খোলা মাঠেই গ্রীষ্ম-বর্ষা পড়ে থাকছে দেহাংশ। এমনকী, ভিসেরা বা অন্য পরীক্ষার জন্য দেহাংশ-দেহরস সংরক্ষণের ব্যবস্থাও নেই হাসপাতালের।
মর্গে ময়না-তদন্তের সহযোগী হিসেবে রয়েছেন উর্মিলা মল্লিক ও শঙ্কর মল্লিক। অস্থায়ী কর্মী হিসাবে প্রায় ২৬ বছর ধরে তাঁরা কাজ করছেন। তাঁদের অভিযোগ, বছরে প্রায় ৭০০ থেকে ৮০০ দেহ ময়না-তদন্ত করা হয় ওই মর্গে। তাঁদের দাবি, ‘‘নিতান্তই বেহাল পরিকাঠামোর মধ্যে আমাদের কাজ করতে হচ্ছে। বর্ষায় ভিজে কখন গ্রীষ্মের প্রখর রোদের মধ্যে দাঁড়িয়ে কাজ করতে হয়। পরিকাঠামো উন্নয়নের জন্য বিভাগীয় দপ্তরে একাধিকবার জানিয়েছি। কিন্তু বছরের পর বছর ঘুরে গেলেও সাড়া মেলেনি।’’ প্রায় একই অভিযোগ, ময়না-তদন্তের দায়িত্বে থাকা অটোপসি সার্জেন অরবিন্দ চট্টোপাধ্যায়ের।
তা হলে উপায়?
ডায়মন্ড হারবারের উপ পুরপ্রধান পান্নালাল হালদার নিয়মরক্ষার আশ্বাস দিয়ে বলেন, ‘‘প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে দেহগুলি সৎকারের ব্যবস্থা করব।’’
কিন্তু কবে? সে উত্তর অবশ্য দুর্গন্ধেই হারিয়ে যাচ্ছে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy