শিক্ষারত্ন অনুষ্ঠান দেখে ফেরার সময়ে অন্য রকম ‘শিক্ষা’ পেল কুলতলির ছাত্রীরা। চোখের সামনেই তারা দেখল, স্কুলের বাসের ধাক্কায় জখম এক প্রৌঢ়কে হাসপাতালে না নিয়ে গিয়ে, বাসে উঠিয়ে ফেলে রাখা হল মেঝেতে। বিনা চিকিৎসায় পথেই ওই ব্যক্তি মারা গেলে প্রধান শিক্ষক ছাত্রীদেরই ধমকালেন, ‘কোনও কথা বলবি না বাড়ি গিয়ে।’ ঘটনার প্রায় চার ঘণ্টা পরে ছাত্রীদের স্কুলে নামিয়ে, দেহ নিয়ে বাসটি চলে যায়।
চোখের সামনে মানুষ মারা গেলেও ঝামেলায় জড়াতে নেই, এমন কড়া শিক্ষাটা হজম করতে পারেনি কুলতলির পাঁচুয়াখালি হাইস্কুলের ছাত্রীরা। একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির ওই পড়ুয়াদের অনেকে বাড়ি ফিরে অসুস্থ পড়ে। ঘটনার কথা জানাজানি হলে প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গির আলম ঘরামির অপসারণের দাবিতে সোমবার স্কুলে বিক্ষোভ দেখান অভিভাবকেরা। পুলিশ, র্যাফ এসে পরিস্থিতি সামাল দেয়।
গত ৬ সেপ্টেম্বর মন্দিরবাজারের দাদপুর মোড়ে উদ্ধার হয়েছিল অজ্ঞাতপরিচয় এক ব্যক্তির দেহ। ছাত্রীদের সঙ্গে কথাবার্তার পর পুলিশ মনে করছে, তাদের বাসের ধাক্কায় নিহত ব্যক্তিরই দেহ সেটি। বয়স বছর পঞ্চান্ন। চালক সুরেশ হালদার সোমবার সন্ধ্যায় গ্রেফতার হয়েছে।
প্রধান শিক্ষক জাহাঙ্গির তৃণমূলের কুলতলি ব্লক শিক্ষা সেলের সভাপতি। দলের স্থানীয় মেরিগঞ্জ অঞ্চল সভাপতিও বটে। তিনি নিজে এ দিন স্কুলে আসেননি, এলাকাতেও ছিলেন না। টেলিফোনে বলেন, “চালক-খালাসি বার বার বলছিল, জখম লোকটিকে হাসপাতালে নিয়ে গেলে থানা-পুলিশ হবে। সে সব সামলে ছাত্রীদের বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়ে যাবে। ছাত্রীদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই বাস এগিয়ে নিয়ে যাই আমরা।”
স্কুল পরিচালন কমিটির সভাপতি প্রশান্ত নস্করও ছিলেন বাসে। প্রধান শিক্ষকের উপরেই দায় চাপিয়ে তিনি বলেন, “প্রধান শিক্ষকই যা সিদ্ধান্ত নেওয়ার নিয়েছেন।” প্রশান্তবাবুর বক্তব্য, “আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। প্রধান শিক্ষক বলেছিলেন, বাস দাঁড় করালে বা হাসপাতালে গেলে আরও গোলমাল পাকাবে। চালকও সে কথা বলছিল।”
ঘটনার কথা শুনেছেন তৃণমূলের জেলা সহ-সভাপতি শক্তি মণ্ডল। তিনি বলেন, “অনিচ্ছাকৃত ভাবে একটা ঘটনা ঘটে গিয়েছে। তদন্ত হয়েছে। অপরাধ প্রমাণ হলে শাস্তি হবে।” দক্ষিণ ২৪ পরগনার স্কুল শিক্ষা আধিকারিক দেবজ্যোতি বড়াল বলেন, “গুরুতর অভিযোগ। খতিয়ে দেখে প্রধান শিক্ষকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
কুলতলির স্কুলটিতে পড়ুয়ার সংখ্যা হাজার দেড়েক। শিক্ষক দিবসে নেতাজি ইন্ডোরের অনুষ্ঠানে স্কুলটিকে নিমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। ৫ সেপ্টেম্বর, শুক্রবার একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির জনা ৪৫ ছাত্রীকে নিয়ে কলকাতা যায় বাসটি। বেলা সাড়ে তিনটে নাগাদ ফেরার পথে এসএসকেএম হাসপাতালের সামনে বাসটি ধাক্কা মারে এক পথচারীকে। জখম প্রৌঢ়কে বাসে টেনে তোলে খালাসি। ছাত্রীরা জানিয়েছে, কালো প্যান্ট-রঙিন জামা পরা ওই ব্যক্তির মাথায়, হাতে, বুকে চোট লাগে। তিনি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলেন। ভাঙা বাংলায় বলেন, “আমাকে হাসপাতালে নিয়ে চলো। না হলে আমি বাঁচব না।”
ছাত্রীদের দাবি, প্রধান শিক্ষক, বাসের চালক-খালাসি এবং অন্য শিক্ষকেরা আশ্বাস দেন, কিছু দূরে গিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। আহত ব্যক্তি জল খেতে চাইলে এক ছাত্রী নিজের বোতল থেকে জল দেয়। ছাত্রীরাও শিক্ষকদের কাছে হাসপাতালে বাস দাঁড় করানোর আর্জি করতে থাকে। অভিযোগ, প্রধান শিক্ষক তখন তিরস্কার করেন ছাত্রীদের। বলেন, “তোরা কিচ্ছু দেখিসনি। চুপ করে বসে থাক। ঝামেলা বাড়াস না।” বাস থেকেই স্কুলে ফোন করে প্রধান শিক্ষক শনিবার স্কুল ছুটি দিয়ে দেন।
ছাত্রীদের দাবি, সন্ধে সাড়ে ৬টা নাগাদ বাস বারুইপুরের কাছাকাছি পৌঁছনোর পরে ওই ব্যক্তি আর সাড়াশব্দ করছিলেন না। ততক্ষণে বাসের আলো নিভিয়ে দেওয়া হয়েছে। ছাত্রীদের কেউ কেউ কান্নাকাটি জুড়েছিল। প্রধান শিক্ষকের ধমক খেতে হয় তাদেরও। মহিষমারিতে নিজের বাড়ির কাছে নেমে যান প্রধান শিক্ষক। সাড়ে ৭টা নাগাদ বাস পৌঁছয় স্কুলে। রাতে ছাত্রীরা কেউ বারবার বমি করে, কেউ খেতে পারে না। কারও কারও প্রাথমিক চিকিৎসাও করাতে হয়।
অভিভাবকদের মধ্যে প্রহ্লাদ নস্কর, মৃত্যুঞ্জয় নস্কর, স্বপন হালদার, স্বপন মণ্ডলরা বলেন, “ভয়ঙ্কর ঘটনা। প্রধান শিক্ষক অত্যন্ত অমানবিকতার পরিচয় দিয়েছেন। ওঁকে অবিলম্বে সরিয়ে দিতে হবে।” পুলিশ সূত্রে খবর, আজ মঙ্গলবার কথা বলা হবে প্রধান শিক্ষকের সঙ্গে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy