এখনও কাজ শেষ হল না ক্যানিং মৌখালি সেতুর। নিজস্ব চিত্র।
এক হাতে সামলাচ্ছেন দলের যুব সংগঠন। অন্য হাতে রয়েছে মূল দলের পদ।
ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা এলাকার বিধায়ক শওকত মোল্লার উপরে দলের এই ‘অতিনির্ভরতা’ এক দিকে ভাল চোখে দেখেন না তৃণমূলের অনেকে। তবে এ কারণেই হয় তো তৃণমূলের গোষ্টীদ্বন্দ্ব সে ভাবে মাথাচাড়া দিতে পারেনি এলাকায়, স্বীকার করতে বাধ্য হন তাঁরাও। গত কয়েক বছরে শওকতের এলাকায় উন্নয়নও যে নজর টানছে— সে কথা পুরোপুরি উড়িয়ে দিতে পারছেন না বিরোধীরাও।
এক সময়ে বোমা, গুলির শব্দে আতঙ্কে ভুগতেন এই বিধানসভার অন্তর্গত জীবনতলার মানুষ। মৌখালির মাতলা নদীর চরের মেছোভেড়ির দখল নিয়ে খুনখারাপি লেগে থাকত। ভেড়ি রাজনীতি নিয়ে অনেক রক্ত বয়ে গিয়েছে বাম আমলে। এক সময়ে দুষ্কৃতীদের ‘আঁতুড়ঘর’ ছিল জীবনতলা। এখন সে সব অতীত। যার কৃতিত্ব শওকতকেই দিতে চান তাঁর দলের লোকজন। দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার অন্যতম পিছিয়ে পড়া ক্যানিং পূর্ব বিধানসভা এলাকায় গত কয়েক বছরে পথঘাট, জল-আলোর মতো বেশ কিছু উন্নয়নের কাজও নজরে আসছে।
তবে ইদানীং ঘাড়ের কাছে নিঃশ্বাস ফেলছেন ফুরফুরাশরিফের পিরজাদা আব্বাস সিদ্দিকি। এই বিধানসভার অন্তর্গত ভাঙড় থানার একটি অংশে সভা করতে গিয়ে তৃণমূলের হাতে তাঁর গাড়িতে হামলা চলে বলে অভিযোগ ওঠে। তারপর থেকে জল গড়িয়েছে অনেক দূর। আব্বাস এখন বিধানসভা ভোটে লড়ার তোড়জোড় শুরু করেছেন। দল ঘোষণা না হলেও ইতিমধ্যে এমআইএম নেতৃত্বকে পাশে পেয়েছেন। ৬৫ শতাংশ সংখ্যালঘু ভোট যেখানে, সেই ক্যানিং পূর্বে আব্বাস প্রার্থী দিলে ভোট কাটাকাটির অঙ্ক কোন দিকে গড়ায়, সে দিকে নজর আছে রাজনৈতিক মহলের।
১৯৭৭ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত টানা এই কেন্দ্র থেকে বিধায়ক ছিলেন আব্দুর রেজ্জাক মোল্লা। তৃণমূলের জমানায় রেজ্জাককে ভাঙড় কেন্দ্রে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছেন তৃণমূল নেত্রী। রেজ্জাকের আমলের অভাব-অভিযোগ সামলাতে নামতে হয়েছিল শওকতকে। সিপিএম ছেড়ে তৃণমূলে আসা শওকত ২০১৬ সালে ভোটের টিকিট তো পেলেনই, দলেও দ্রুত হয়ে উঠলেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘনিষ্ঠ। সিপিএমের আজিজার রহমান মোল্লাকে ৫৫,০৩৪ ভোটে হারিয়ে জয়ী হয়ে ‘দিদি’র ভরসাও জিতে নেন। জেলার যুব তৃণমূলের সভাপতি করা হয় পরে। সেই সঙ্গে এখন দলের তৃণমূলের ব্লক সভাপতির পদ আছে তাঁর হাতে।
তবে জল নিকাশির পুরোপুরি উন্নতি হয়নি বলে ক্ষোভ আছে মানুষের। অভিযোগ, বর্ষায় এখনও বহু এলাকা জলে ডুবে থাকে। ক্যানিং-মৌখালি সেতুর কাজ শেষ হয়নি। মঠেরদিঘি ও খুঁচিতলা হাসপাতালের আরও উন্নয়ন প্রয়োজন বলে মনে করেন স্থানীয় মানুষ। বিধানসভা এলাকায় এখনও পর্যন্ত বেশ কিছু রাস্তার কাজ শেষ হয়নি। প্রতিটি বাড়িতে এখনও পানীয় জলের পাইপলাইন পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়নি। গ্রামের ভিতরের রাস্তাঘাট ভাঙাচোরা বলে অভিযোগ।
তবে এলাকায় উন্নয়নের দীর্ঘ তালিকার কথা উল্লেখ করেন বিধায়ক। জানালেন, পাঁচ বছরে বিধানসভা এলাকায় ৪৮টি জুনিয়র হাইস্কুল তৈরি হয়েছে। ৪টি হাইস্কুল তৈরি হয়েছে। ইংরেজি মিডিয়াম হাইমাদ্রাসা, নবোদয় বিদ্যালয়, আইটিআই কলেজ তৈরি হয়েছে। প্রায় সব বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হয়েছে। বিধানসভা এলাকার প্রতিটি বাজারে হাইমাস্ট টাওয়ার বসেছে। থানার নতুন ভবন তৈরি হয়েছে। বিভিন্ন এলাকায় কর্মতীর্থ বাজার, পথের সাথী, যাত্রী ছাউনি তৈরি হয়েছে। প্রধান রাস্তাগুলি ঝাঁ-চকচকে হয়েছে। নিকাশি ব্যবস্থা ঢেলে সাজতে কুড়িয়াভাঙা পাম্পিং স্টেশনের কাজ শেষ করা হয়েছে। দেড় কোটি টাকা ব্যয়ে কমিউনিটি হল তৈরি হয়েছে। ক্যানিং-মৌখালি সেতু নির্মাণের কাজ শেষের পথে। এক ফসলি জমিকে তিন ফসলি করার লক্ষ্যে খাল কাটার লক্ষ্যমাত্রা নেওয়া হয়েছে।
বিরোধীদের অভিযোগ, কাজ কিছু হয়েছে ঠিকই, কিন্তু সঙ্গে আরও যা হয়েছে— তা হল গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ। বিরোধীদের মাথা তুলতে দেওয়া হয় না বলে অভিযোগ।
আরএসপির প্রাক্তন বিধায়ক তথা প্রাক্তন সেচমন্ত্রী সুভাষ নস্কর বলেন, ‘‘ওই বিধানসভা এলাকায় কোনও গণতন্ত্র নেই। বিরোধী রাজনৈতিক দলকে মাথা তুলতে দেওয়া হয় না।’’ এলাকায় একশো দিনের কাজ নিয়ে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে বলে অভিযোগ তাঁর। উন্নয়নের নামে প্রচুর সরকারি টাকা লুট হয়েছে বলেও অভিযোগ। তবে রাস্তাঘাট-সহ কিছু কাজ হয়েছে বলে মানছেন সুভাষ।
জেলার বিজেপির কিসান মোর্চার সভাপতি সুদর্শন গোস্বামী বলেন, ‘‘বিধানসভা এলাকার প্রধান সড়কপথগুলির কিছুটা উন্নতি হলেও গ্রামীণ রাস্তাঘাট আজও খারাপ। নিকাশি ব্যবস্থার উন্নতি হয়নি। ক্যানিং-মৌখালি সেতুর কাজ শেষ হয়নি। বিধানসভা এলাকায় ভূগর্ভস্থ জল তুলে মাছ চাষের কাজে লাগানো হচ্ছে। ফলে আগামী দিনে তীব্র জল সঙ্কট দেখা দিতে পারে। সেচের জলের সমস্যা তো আছেই।’’
শওকত এ সব অভিযোগ মানতে নারাজ। বলেন, ‘‘উন্নয়নের ত্রুটি খুঁজে বের করতে না পেরে অনেক কথা বলেন বিরোধীরা। আমপান থেকে করোনা—দিনরাত জেগে মানুষের সেবা করে গিয়েছি। লকডাউনের মধ্যে কয়েক লক্ষ গরিব মানুষের মুখে দু’বেলা অন্নদা প্রকল্পে কমিউনিটি কিচেনের মাধ্যমে খাবার তুলে দিয়েছি। পাঁচ বছরে আমি কী কাজ করেছি, মানুষই তার বিচার করবেন।’’ তাঁর কথায়, ‘‘কিছু কাজ বাকি রয়েছে। প্রতিটি বাড়িতে পানীয় জল পৌঁছে দিতে চাই। ক্যানিং-মৌখালি সেতুর কাজ দ্রুত শেষ করে কলকাতার সঙ্গে সুন্দরবনের যোগাযোগ ব্যবস্থা আরও ভাল করতে চাই।’’
কিন্তু দলের অন্দরে গোলমাল সামাল দিয়ে চলেছেন কী ভাবে? শওকত বলেন, ‘‘আমাদের দলে সকলকে মর্যাদা দেওয়া হয়। কারও কোনও সমস্যা নেই।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy