নেশায় আসক্ত দু’জন। বনগাঁয়। ছবি: নির্মাল্য প্রামাণিক
এক ফোনেই বাড়ি বসে ডেলিভারি মিলবে হেরোইনের। বনগাঁ শহর এবং সংলগ্ন এলাকায় এখন এ ভাবেই চলছে মাদকের খুচরো কারবার। কারবারিদের একাংশও নেশায় আসক্ত।
কয়েক বছর আগেও বনগাঁয় প্রকাশ্যে হেরোইনের খুচরো কারবার চলত। পাড়ার কিছু বাড়িতেই ভিড় করত ক্রেতারা। সে সব জায়গায় বসে নেশা করারও বন্দোবস্ত ছিল। কিন্তু পুলিশের নিয়মিত ধরপাকড় এবং স্থানীয় বাসিন্দাদের প্রতিরোধের ফলে ইদানীং প্রকাশ্যে হেরোইনের বিক্রি অনেকটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। তবে সম্পূর্ণ বন্ধ হয়নি।
রবিবার রাতে রামকৃষ্ণপল্লি এলাকায় হেরোইন নিয়েই গন্ডগোল বাধে। তাতে ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় এক বৃদ্ধের। তাঁর স্ত্রী-ছেলে চিকিৎসাধীন। ওই এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছেন, আরও কয়েকটি বাড়িতে এই এলাকায় গোপনে হেরোইন বিক্রি হয়। কোথাও কোথাও ফোন করলে বাড়িতে হেরোইন পৌঁছেও দেয় কারবারিরা।
রামকৃষ্ণপল্লি, পাইকপাড়া, নেতাজি মার্কেট, জয়পুর, বনগাঁ স্টেশন এলাকা-সহ কয়েকটি জায়গায় হেরোইন খুচরো বিক্রি হয় বলে জানা গেল স্থানীয় সূত্রে। কারা কোথায় হেরোইন বিক্রি করে—সেই খবরও থাকে নেশাড়ুদের কাছে। মূলত মোবাইলেই কারবার চলে বলে পুলিশের নজরেও আসে কম। স্থানীয় প্রতিরোধও তৈরি হওয়ার সুযোগ মেলে না।
নেশাসক্ত এক যুবক জানালেন, হেরোইন বিক্রি হয় দেশলাই কাঠির ওজন হিসাবে। ওই ওজনের হেরোইন বিক্রি হয় ২০০ টাকায়। আড়াই কাঠি দেশলাই ওজনের হেরোইনের মূল্য ৬০০ টাকা। একটি রাংতার কাগজ নৌকোর মতো ভাঁজ করে তাতে হেরোইন ঢেলে গোল হয়ে বসে চলে সুখটান। কেউ কেউ আবার সিগারেটের মধ্যে পুরেও হেরোইনের নেশা করে।
স্থানীয় বাসিন্দারা জানালেন, হেরোইনের নেশায় আসক্ত হয়ে অনেক পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে গিয়েছে। বনগাঁর খয়রামারি এলাকার এক যুবক নেশার টাকা জোগাড় করতে বাড়ির জিনিসপত্র বিক্রি করে দিয়েছিলেন। বাড়ি থেকে টাকা চুরি করে বা নিজের বাইক বন্ধক রেখে নেশা করতেন। সম্প্রতি তাঁকে পরিবারের লোকজন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে নেশামুক্তি কেন্দ্রে ভর্তি করেছেন। ছেলের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেললেন নরহরিপুর এলাকার এক মহিলা। তাঁর ছেলেও নেশায় আসক্ত। স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতে লড়াই করছেন মা। চোখের জল মুছে মহিলা বললেন, ‘‘বাড়িতে চাল কিনে এনে রাখতে পারি না। ছেলে চাল, শাড়ি, বাসন চুরি করে বিক্রি করে দেয়। নেশার টাকা জোগাড় করে এ ভাবেই।’’ অতীতে পেট্রাপোল থানা এলাকার পেট্রাপোল, নরহরিপুর, ফিরোজপুর, খলিতপুর, ছয়ঘড়িয়া, জয়পুর এলাকায় হেরোইনের নেশায় আসক্ত হয়ে রোগে ভুগে মারা গিয়েছেন বহু যুবক। স্থানীয় মানুষের হিসাব অনুয়ায়ী, মৃত্যুর সংখ্যাটা জনা কুড়ি তো হবেই!
স্থানীয় খলিতপুরে গ্রামে থাকতেন রতন মণ্ডল। তাঁর মোট ন’য় ছেলের মধ্যে চার জনই হেরোইনের নেশায় মারা গিয়েছেন। ছেলেদের মৃত্যু সহ্য করতে না পেরে রতন ও তাঁর স্ত্রীও মারা যান। জানা গেল, নেশায় আসক্তেরা অনেকে বাড়ি থেকে চুরি করে সুবিধা করতে না পারলে পাড়ায় বেরিয়েও চুরি-ছিনতাই শুরু করে। গণধোলাই জোটে কখনও সখনও।
জামতলা এলাকায় এক সময়ে ‘হেরোইন-হাট’ বসত। দূর থেকে মহিলা, পুরুষ, ছাত্রছাত্রীরা আসত। এখন অবশ্য সেখানে প্রকাশ্যে হেরোইনের নেশা বা বিক্রি হয় না। জয়পুর এলাকায় বাড়িতে হেরোইন বিক্রি হত। এলাকার লোকজন এককাট্টা হয়ে পথে নেমে সে সব বন্ধ করে দিয়েছেন। মহিলারা এগিয়ে এসেছিলেন। তাঁদের একজন তহিরুন খাতুন বলেন, ‘‘প্রকাশ্যে এখন বিক্রি না হলেও মোবাইলে অর্ডার দিয়ে কারবার চলে। আমরা ফের আন্দোলনের প্রস্তুতি নিচ্ছি।’’
পুলিশের বক্তব্য, খুচরো বিক্রি যারা করে, তারা নিজেরাও নেশা করে। তাদের ধরে এনে রাখাটাও বিপজ্জনক। কারণ, নেশার টান উঠলে মাদক না পেলে মৃত্যুর আশঙ্কাও থাকে।’’ তা হলে কী কোনও পদক্ষেপ করা হবে না? পুলিশের এক আধিকারিক জানান, প্রকাশ্যে বিক্রি এখন বন্ধ হয়েছে। যে সব বাড়িতে লুকিয়ে বিক্রি হচ্ছে, সেগুলিকে শনাক্ত করা হচ্ছে। কড়া পদক্ষেপ করা হবে। নেশায় আসক্তদের সমাজের মূল স্রোতে ফিরিয়ে আনতে কাজ করে একটি সংগঠন। তার সম্পাদক পপ আচার্য বলেন, ‘‘আমরা বনগাঁয় নিয়মিত নেশার বিরুদ্ধে মানুষকে সচেতন করি। নেশায় আসক্তদের চিহ্নিত করে চিকিৎসার ব্যবস্থা করলে সমস্যা মিটবে। কারবারিদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ করতে পুলিশকে সহযোগিতা করছি।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy