‘যাবেন না স্যার’— আকুতি ছাত্রছাত্রীদের। ছবি: নির্মল বসু।
প্রধান শিক্ষকের স্কুল ছাড়ার সিদ্ধান্ত বদলে গেল ছাত্রছাত্রীদের আকুতি আর চোখের জলে।
স্কুল গেটে তালা ঝুলিয়ে, পোস্টার, মাইক নিয়ে ঘণ্টা তিনেক ধর্না চালায় ছেলেমেয়ের দল। গ্রামের লোকজনও যোগ দিয়েছিলেন সেখানে। পরে প্রধান শিক্ষক যখন মাইক্রোফোন হাতে বললেন, ‘‘তোমাদের ভালবাসায় আমি কেবল মুগ্ধ, অভিভূত। তাই তোমাদের মতো ছাত্রছাত্রী এবং গ্রামবাসীর কথা বিবেচনা করে স্কুল ছাড়ার সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য হচ্ছি।’’ কথা বলতে গিয়ে প্রধান শিক্ষকেরও গলা ধরে আসে। চোখ ভরে আসে জলে। ছাত্রছাত্রীদেরও অনেককে চোখ মুছতে দেখা গেল। সব মিলিয়ে মধুরেণ সমাপয়েৎ। ছেলেমেয়েরা ক্লাসে বসে।
বসিরহাট ২ ব্লকের রাজেন্দ্রপুর পঞ্চায়েতের গাড়াকপি গ্রামে ঝুরুলি আদর্শ বিদ্যাপীঠ। গ্রামের মানুষের উদ্যোগে ১৯৭৪ সালে স্কুলটির প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯৯৯ সালে সরকারি অনুমোদন মেলে। ২০০৭ সালে সেখানেই প্রধান শিক্ষক হিসাবে যোগ দেন বারাসতের বাসিন্দা পার্থপ্রতিম বেরা। এরপরে স্কুলটি প্রাথমিক থেকে উন্নীত হয়ে ২০১০ সালে মাধ্যমিক এবং ২০১৩ সালে উচ্চমাধ্যমিকে পরিণত হয়। পার্থবাবু যখন স্কুলে যোগ দিয়েছিলেন, তখন পড়ুয়ার সংখ্যা মেরেকেটে শ’চারেক। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৮৬৯ জন।
সকলেরই বক্তব্য, প্রধান শিক্ষককের চেষ্টা এবং আন্তরিকতায় পঠন-পাঠন সহ সব দিকে তরতর করে এগিয়ে চলেছে স্কুল। এক সময়ে ছিল মাটির দেওয়াল আর খড়ের চাল দেওয়া ৫-৬টি ঘর। এখন দোতলা বাড়ির চারটি ব্লকে ২০টি বড় বড় ক্লাস ঘর। আরও ঘর হচ্ছে। এই অবস্থায় কোন ভাবেই প্রধান শিক্ষককে স্কুল থেকে ছাড়া সম্ভব নয়।
কিন্তু কেন স্কুল ছাড়তে চাইছিলেন পার্থপ্রতিমবাবু?
স্কুল কর্তৃপক্ষে সূত্রে জানা গেছে, ইদানীং তাঁর উন্নয়নমূলক কাজে কেউ কেউ বাধা দিচ্ছিলেন। তা নিয়ে মনোমালিন্যর পাশাপাশি স্কুলে যাওয়ার জন্য যাতায়াতেরও অসুবিধা হচ্ছিল পার্থপ্রতিমবাবুর। খোলাপোতা থেকে ঝুরুলি প্রায় দশ কিলোমিটার রাস্তা বেশ খারাপ। মাঝে অসুস্থ হয়ে পড়ছিলেন ওই শিক্ষক। তাই বারাসতের বাড়ি থেকে মাত্র তিন কিলোমিটার দূরের একটি স্কুলে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মঙ্গলবার স্কুল থেকে প্রধান শিক্ষকের ‘রিলিজ’ নেওয়ার কথা ছিল। সে কথা জানতে পেরেই আটকে দেন সকলে।
দশম শ্রেণির ছাত্র সাহিন দফাদার, নবম শ্রেণির পলি খাতুনরা বলে, ‘‘প্রধান শিক্ষকের চেষ্টায় স্কুলের পঠন-পাঠনের পরিবেশ সম্পূর্ণ বদলে গিয়েছে। উনি আমাদের খুব স্নেহও করেন। স্যারকে কোনও ভাবেই ছাড়া যাবে না। আমরা নিজেরাই চাঁদা তুলে, মাইক ভাড়া করে, পোস্টার ছাপিয়ে আন্দোলনে নেমেছি।’’ শিক্ষক-শিক্ষিকাদের মধ্যে সোমা মল্লিক, মোন্তাকিমুল হকরা বলেন, ‘‘উনি আমাদের গর্ব। ছাত্রছাত্রীদের নিজের সন্তানের মতো ভালবাসেন। সহকর্মীদের সমস্ত কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনেন। স্কুলের উন্নয়নের স্বার্থে পার্থবাবুর মতো মানুষ জরুরি।’’
আর আবেগে ভেসে যেতে যেতে কী বললেন পার্থবাবু?
তাঁর কথায়, ‘‘একে স্কুলের পথে রাস্তা খুব খারাপ। তার উপরে বারাসত থেকে প্রায় ৫০ কিলোমিটার উজিয়ে আসতে হয় বলেই বাড়ির কাছাকাছি স্কুলে আপসে বদলি নিয়েছিলাম। একা না করলে হয় তো বুঝতেই পারতাম না, এত মানুষ আমাকে কত ভালবাসে।’’ তাঁর উপলব্ধি, ‘‘এত মানুষের চোখের জলকে উপেক্ষা করি কী করে!’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy