মধু সংগ্রহ শুরু হল সুন্দরবনে। শুক্রবার থেকে সরকারি ভাবে মধু সংগ্রহ অভিযান শুরু হয়েছে। সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের অন্তর্গত সজনেখালি ও বসিরহাট দু’টি রেঞ্জ মিলিয়ে প্রায় সাড়ে চারশো মউলে (মধু সংগ্রহকারী) মধু সংগ্রহ অভিযানে নেমেছেন। এ বারও ন্যূনতম ২০ টন মধু সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্প। তবে এর থেকে অনেক বেশি মধু মিলবে বলেই আশাবাদী বন দফতর।
শুক্রবার বসিরহাট রেঞ্জে ৩৭টি দলে ৩১৪ জন ও সজনেখালি রেঞ্জে ১৪টি দলে ১৩০ জন মউলে জঙ্গলে মধু সংগ্রহের উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছেন। সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের ডেপুটি ফিল্ড ডিরেক্টর জোন্স জাস্টিন বলেন, “এ বার শীতের মরসুম হঠাৎ শেষ হয়ে যেতেই মৌমাছিরা প্রায় মাসখানেক আগেই চলে এসেছে সুন্দরবনে। ফলে অনেক বেশি মধু পাওয়া যাবে বলে আমরা আশাবাদী। আগামী এক মাস ধরে চলবে এই মধু সংগ্রহ।” তিনি জানান, মউলেরা যাতে সঠিক পদ্ধতিতে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ভাবে মধু সংগ্রহ করতে পারেন, সে কারণে তাঁদের দু’দফায় প্রশিক্ষণও দেওয়া হয়েছে সুন্দরবন ব্যাঘ্র প্রকল্পের তরফ থেকে।
সুন্দরবনের মধু জিআই ট্যাগ পাওয়ার পর থেকে দেশে ও বিদেশে এই মধুর চাহিদা অনেকটাই বেড়েছে। সে কারণে মধু যাতে সঠিক ভাবে সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করা হয়, সে দিকে বিশেষ নজর দিচ্ছে বন দফতর। জোন্স বলেন, “এক দিকে যেমন আমরা মধুর গুণগত মান সঠিক রাখতে মউলেদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি, তেমনই মধুর দামও বাড়িয়েছি যাতে মউলেরা আর্থিক ভাবে লাভবান হন।”
ব্যাঘ্র প্রকল্প সূত্রে জানা গিয়েছে, ‘এ গ্রেড’ মধুর জন্য গত বার মউলেরা দাম পেয়েছেন কেজি প্রতি ২৭০ টাকা। এ বার তাঁরা পাবেন ২৭৫ টাকা। ‘বি গ্রেড’ মধুর ক্ষেত্রেও ৫ টাকা কেজি প্রতি বাড়িয়ে দাম করা হয়েছে ২৪০ টাকা। বন দফতরের এই সিদ্ধান্তে খুশি মউলেরা।
মধু সংগ্রহের সময়ে বাংলাদেশি জলদস্যুদের হামলার হাত থেকে মউলেদের রক্ষা করতে নদীপথে নজরদারিও বাড়ানো হয়েছে বলে জানান বন আধিকারিকেরা। শুক্রবার বনবিবির পুজো দিয়ে জঙ্গলের উদ্দেশ্যে রওনা দেন পাখিরালয়ের বাসিন্দা সুখময় জানা, হরিপদ সর্দারদের মতো মউলেরা। জঙ্গলে বিপদ থাকলেও পেটের তাগিদেই মধু সংগ্রহে যেতে হয় বলে জানিয়েছেন তাঁরা। মউলেদের কথায়, ‘‘মাছের প্রজননের জন্য তিন মাস নদী-খাঁড়িতে মাছ ধরা নিষেধ। মধু সংগ্রহে না গেলে সংসার চলবে কী ভাবে?”
স্বামী-সন্তানেরা যখন ‘মহলে’ (মধু সংগ্রহ অভিযান) যান করতে যান, তখন বাড়িতে বেশ কিছু নিয়ম মেনে চলেন মহিলারা। দিনের বেলায় কার্যত কোনও কাজ করেন না তাঁরা। সাজগোজ থেকে শুরু করে রান্নাবান্না সবই হয় সূর্যাস্তের পরে। সূর্য ওঠার আগে ফের রান্নাবান্না, খাওয়া-দাওয়া সেরে নেন সকলে। মহল শেষ না হলে অনেকে বিধবার মতো দিনযাপনও করেন। দয়াপুরের বাসিন্দা সুনীতা মাইতি বলেন, “বছরের পর বছর এই রীতি চলে আসছে। এগুলি মেনে চললে জঙ্গলে বিপদ হয় না। বাঘ-কুমির, ডাকাতদের হাতে পড়ে যাতে কোনও ক্ষতি না হয়, সে কারণে এ সব আমরা মেনে চলি।”
(এই প্রতিবেদনটি আনন্দবাজার পত্রিকার মুদ্রিত সংস্করণ থেকে নেওয়া হয়েছে)