Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪

অসুস্থ ছেলেকে নিয়ে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু

শুক্রবার রাতে আগরপাড়ার গাঁধীনগরের ৬ নম্বর রেল গেটের কাছে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয়েছে শ্যামল দাস (৪৮) এবং তাঁর সন্তান দীপ দাসের (৯)। পুলিশ জানায়, এই ঘটনায় একটি সুইসাইড নোট মিলেছে।

দীপ দাস ও শ্যামল দাস

দীপ দাস ও শ্যামল দাস

নিজস্ব সংবাদদাতা
শেষ আপডেট: ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৩:১০
Share: Save:

ইট দিয়ে উঁচু করা তক্তপোষের উপরে পরপর গুছিয়ে রাখা খান ছয়েক বালিশ। তক্তপোষের নীচে ওষুধের শিশি, বেবি ফুড, দু’টো আপেল। মাথার উপরে রং চটা সিলিং ফ্যানটা ঘ্যাঁচঘ্যাঁচ শব্দ করে ঘুরে চলেছে। বাড়ির মেঝেয় বসে মাঝবয়সি মানুষটা কথা বলার জন্য শব্দ হাতড়ে চলেছেন।

বেশ খানিকটা সময় নিয়ে তিনি বললেন, ‘‘জানেন, সারা দিন ওই বালিশগুলো নিয়েই শুয়ে থাকত দীপ। শেষ দিকে আর নড়াচড়ার ক্ষমতা ছিল না ওর। দেখে কষ্ট হত।’’ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন তিনি। ফের শুরু করেন, ‘‘শেষ দিকে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল দীপ। ভাইও খেত না। খাবারের থালা নিয়ে ছেলের সামনে বসে থাকত। ছেলেটা যে আর থাকবে না, বুঝতে পেরেই এই পথ বেছে নিল ও।’’

শুক্রবার রাতে আগরপাড়ার গাঁধীনগরের ৬ নম্বর রেল গেটের কাছে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয়েছে শ্যামল দাস (৪৮) এবং তাঁর সন্তান দীপ দাসের (৯)। পুলিশ জানায়, এই ঘটনায় একটি সুইসাইড নোট মিলেছে। শ্যামলবাবুর নাম করে তাতে লেখা আছে, ‘‘দাদা আমাকে ক্ষমা করিস। আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ী নয়। ছেলেটা আর সুস্থ হবে না। আমি কী করে, কাকে নিয়ে বাঁচব?’’ সব দেখে পুলিশের ধারণা, এটি আত্মহত্যার ঘটনা।

শনিবার গাঁধীনগরের বাড়িতে বসে সেই আত্মহত্যার পথের কথাই বলছিলেন বিমলবাবু। পরিবারের অনুমান, ওই রাতে ছেলে দীপকে কোলে নিয়ে চলন্ত ট্রেনের সামনে ঝাঁপ দেন শ্যামল। একই বাড়ির অন্য দিকে থাকেন শ্যামলবাবুর দাদা বিমলবাবু। মাস তিনেক আগে তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হয়েছে। এরই মধ্যে ভাই এবং ভাইপোকে এ ভাবে হারিয়ে দিশেহারা তিনি।

শ্যামলবাবু এক়টি সাইকেল মেরামতের দোকান চালাতেন। ব্যারাকপুর গাঁধীঘাট এলাকার বেলা দাসের সঙ্গে বছর দশেক আগে বিয়ে হয় তাঁর। বিয়ের বছর খানেক পরেই দীপের জন্ম। বিমলবাবুর দাবি, বেলাদেবীর স্নায়ুর রোগ ছিল।

বিয়ের আগে তা জানতেন না শ্যামলবাবু। দীপের যখন তিন মাস বয়স, গায়ে আগুন দিয়ে আত্মহত্যা করেন বেলাদেবী।

সেই ঘটনার পর থেকে দীপকে দেখাশোনা করতেন বিমলবাবুর স্ত্রী লিপিকা এবং তাঁর মেয়েরা। দোকানের সময়টুকু ছাড়া বাকি সময় ছেলের সঙ্গেই কাটাতেন শ্যামলবাবু। তবে কিছুটা বড় হতেই স্নায়ুর রোগ ধরা পড়ে দীপের। হাঁটাচলা করতে পারত না সে। কথাও বলত না। বিমলবাবুর মেয়ে সোমা বলেন, ‘‘ছেলের চিকিৎসা বা যত্নে কোনও ত্রুটি করত না কাকা। হেল্থ ড্রিঙ্ক, ফল কোনও কিছুই বাদ দিত না। আমাদের বলত, তোরা ভাইকে ঠিকমতো খাওয়াস। দীপই ছিল কাকার প্রাণ। অনেক জোরাজুরি করার পরেও কাকা শুধুমাত্র ভাইয়ের জন্যই আর বিয়ে করেনি।’’

গত মে মাসে হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু হয় লিপিকাদেবীর। তার পরে দীপের সব ভার এসে পড়ে শ্যামলবাবুর উপরেই। রান্নাবান্না থেকে শুরু করে সব কিছুই করতে হত তাঁকে। এরই মধ্যে মাসখানেক আগে চিকেন পক্স হয় দীপের। তা সারতে না সারতেই গলায় সংক্রমণ। তাকে ভর্তি করা হয় সাগর দত্ত মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। আর সুস্থ করা যায়নি দীপকে। হাসপাতালে থেকে ছেলেকে বাড়িতে নিয়ে আসেন শ্যামলবাবু।

পারিবার সূত্রে জানা গিয়েছে, গত এক মাস ধরে ছেলেকে নিয়েই পড়ে থাকতেন শ্যামলবাবু। গত দু’সপ্তাহে খাওয়া প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল দীপ। শেষ দু’দিন প্রায় কিছুই খায়নি সে। ওজন কমে শীর্ণ হয়ে গিয়েছিল। বিমলবাবু বলেন, ‘‘শুক্রবার সকালে দেখলাম, ভাই দীপের পাশে বসে কিছু লিখছে। ভেবেছিলাম হিসেব করছে। আমি বলেছিলাম, দোকান খুলতে পারছিস না। তিন হাজার টাকা রাখ। কিন্তু ও বলে, টাকা আছে। শুধু ছেলেটা সেরে উঠলেই হয়। এখন বুঝতে পারছি, তখনই সুইসাইড নোট লিখছিল ও।’’

রেলপুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, শুক্রবার সন্ধ্যার পরে সকলের অগোচরে ছেলেকে কোলে তুলে বেরিয়ে যান শ্যামলবাবু। রাতে দমদম জিআরপি-র কাছে খবর যায়, ট্রেনের ধাক্কায় মৃত্যু হয়েছে দু’জনের। রাত ১০টা নাগাদ শ্যামলবাবু ও দীপের দেহ শনাক্ত করেন বিমলবাবু।

অন্য বিষয়গুলি:

Death Suicide
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy