অগত্যা: সন্তান কোলে অনিতা, ত্রাণের খিচুড়ি খাওয়াচ্ছেন বাধ্য হয়ে— নিজস্ব চিত্র
রাস্তার ধারে যখনই গাড়ির চাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে, স্কুল ঘরের ভিতরে বসে থাকা মানুষগুলো উৎকর্ণ হয়ে উঠছে। খুদে খুদে পায়ে এসে গাড়িগুলো ঘিরে ধরছে গ্রামের কাচ্চাবাচ্চার দল। উৎসাহ নিয়ে হাত পাতছে ওরা, যদি দু’টো বিস্কুট মেলে।
সুন্দরবনের কুলতলির ভুবনেশ্বরী পঞ্চায়েত। ত্রাণবিলির জন্য কলকাতা থেকে আসা ম্যাটাডরের সামনে গ্রামের মেয়ে-বৌদের লম্বা লাইন। দূরে স্কুলের বারান্দায় মুখ ঢেকে বসেছিলেন ক’জন মহিলা। তাঁদের চোখেমুখে চাপা অস্বস্তি। প্রশ্ন করা গেল, কত জন আমপানে বাড়ি-ঘর হারিয়ে এসে উঠেছেন এই স্কুল ঘরে? উত্তরটা ভাসা ভাসা এল নেতা গোছের একজনের থেকে— ‘‘আমরা তিনশো-চারশোজন এখানে আছি। আমাদের দু’বেলা খেতে দেওয়া হচ্ছে একজনের স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার তরফে।’’
জানা গেল, মাটির বাড়ি ভাঙায় সরকারি ক্ষতিপূরণ পাওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে। তাই গ্রামের ভিতরের লোকের রাগ। তাঁদের ক্ষোভ, নদীপারের কাঁচা মাটির বাড়ির মানুষগুলোই শুধু সাহায্যের টাকা পাবে কেন! আর যারা এত কষ্ট করে টাকা জমিয়ে পাকাবাড়ি তুলেছে, তারা কী দোষ করল? ছাদহারাদের সঙ্গে ছাদযুক্তদের অঘোষিত রেষারেষি চলছে। তাই স্কুলবাড়িতে নদীপারের ঘরহারা পরিবার খানিক কোণঠাসা।
স্কুলের বারান্দায় বসেছিলেন পাশের গ্রামের ভিটেহারা অনিতা দাস। কোলে দেড় বছরের শিশু। ত্রাণের ঝাল খিচুড়িই খাচ্ছে শিশুটি, তাকে খাওয়ানোর জন্য আলাদা করে দুধ কেনার পয়সা নেই। জানালেন, মায়ের বুকের দুধ আর ত্রাণের খাবারেই বেঁচে আছে ছাদহীন সন্তান। তাই এক গ্রাস করে সন্তানের মুখে খিচুড়ি আর এক বার করে জলের জাগ থেকে জল— নাকের জলে, চোখের জলে অবস্থা শিশুটির।
অনিতা বলেন, ‘‘কী করব! খেতে দেওয়ার কিছু নেই তো। জলে সব ভেসে গিয়েছে। এখন না হয় তা-ও খেতে পাচ্ছি। এর পর কোথায় যাব, কী ভাবে চলবে জানি না।’’
স্থানীয় বাসিন্দারা জানাচ্ছেন, নদীপারের গ্রাম হালদারঘিরি নদীবাঁধ ভেঙে নোনা জলে ধুয়েমুছে সাফ হয়ে গিয়েছে। নস্করঘিরি গ্রাম থেকে তিন-চার কিলোমিটার দূরের সেই গ্রামের বর্তমান অবস্থা দেখাতে নিয়ে গেলেন মেয়েরাই। যেতে যেতে পথে জানা গেল, হালদারঘিরি গ্রামের সরস্বতী গিরির পঁচানব্বই বছরের শ্বশুরের বেঁচে যাওয়ার গল্প। নড়াচড়ায় অক্ষম যদুপতি গিরিকে আমপানের দিন বিকেলে বাচ্চাদের দোলনায় বসিয়ে চারজন কাঁধে করে ঝুলিয়ে কোনও মতে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছিল উঁচু জায়গার পাকা স্কুলবাড়িতে। সে দিন যখন বানের জল ঢুকছিল হু-হু করে, তখন বাঁচতেন না বয়স্ক মানুষটি।
সরস্বতী বলেন, ‘‘ওই দিন সন্ধ্যায় যখন জল ঢুকছে হুড়মুড়িয়ে, প্রাণ বাঁচাতে যে যেদিকে পারে দৌড় দিলাম। বাচ্চা কোলে, লোক, ছেলে-মেয়ে সকলে ছুটছে। কারও তাকানোর অবস্থাও নেই। সকলে ছুটছে প্রাণ বাঁচাতে।’’ হালদারঘিরি এখন শুধু গ্রামের নাম, গ্রামসুলভ আর কিছুই অবশিষ্ট নেই সেখানে। মাটির বাড়ির দেওয়ালগুলো ধসে গিয়েছে, এ দিক ও দিক ছড়িয়ে আছে কারও ঘরের খড়ের ছাউনি, ভাঙা খাট, রান্না করার হাঁড়ি, খুন্তি। জমিতে এখনও হাঁটুর উপরে জল দাঁড়িয়ে। আলপথ কোথাও আধডোবা। যেখানে জল নেমেছে সেখানে পায়ের নীচের মাটিতে জুতো বসে যাচ্ছে একটু অসতর্ক হলেই।
ওই গ্রামেরই নমিতা দাস জানালেন, শখ করে ট্রাঙ্ক কিনেছিলেন, শীতের লেপ, তোশক রাখবেন বলে। ঝড়ে দেওয়াল পড়ে সে ট্রাঙ্ক দুমড়েমুচড়ে গিয়েছে। আমপান এসে তাঁর জীবনের সব থেকে দামি সম্পত্তিটি গ্রাস করেছে। সে কষ্টের কথা বারবার বলেন নমিতা— ‘‘জানেন দিদি, মিন ধরে টাকা জমিয়ে ওই ট্রাঙ্ক কিনেছিলাম। আড়াই হাজার টাকা! কী কষ্ট করে... সেটা ভেঙেচুরে একেবারে শেষ। ভিতরে যা ছিল তা-ও নষ্ট হয়ে গিয়েছে। আমার ভাল কাপড়গুলোয় সব কাদার দাগ। জলের নীচে তিন-চার দিন ছিল তো। তুলে-ধুয়ে কত করে কাচলাম। ভ্যাপসা গন্ধ গেলই না!’’
আপাতত, স্কুলছাদে জলে ডোবা আধপচা চাল রোদে শুকিয়ে আগামী দিনের বন্দোবস্ত করছেন ওঁরা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy