জিরো-পয়েন্ট: সাগরের ধবলাট পঞ্চায়েতের বহু মানুষ এখনও এ ভাবেই কোনও মতে মাথা গুঁজে আছেন। ছবি: দিলীপ নস্কর
লকডাউনে চাকা বন্ধ শিল্পে। কাজ হারিয়েছেন বহু শ্রমিকে। ভিন্ রাজ্য থেকে বাড়ি ফিরেছেন অনেকেই। কিন্তু আমপানের দাপটে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার বিস্তীর্ণ অংশে অর্থনীতি বড়সড় ধাক্কা খেয়েছে। এই পরিস্থিতিতে স্থানীয় ভাবে কাজ জুটবে কিনা, তা নিয়ে সংশয়ে ভিন্ রাজ্য থেকে ফেরা মানুষজন। যাংরা এত দিন কৃষিকাজ করে, মাছ ধরে বা ছোট ব্যবসা করে সংসার চালাচ্ছিলেন, তাঁরাও পড়েছেন কঠিন সঙ্কটে।
অর্থনীতিবিদেরা বলছেন, এই মুহূর্তে চাষিদের হাতে অর্থ না এলে প্রভাব পড়বে অন্য ক্ষেত্রেও। ফসল ভাল না হলে আড়ত, ধানকল-চালকল থেকে শুরু করে কৃষিভিত্তিক অন্যান্য শিল্পও ধাক্কা খাবে। গ্রামের বাজার-দোকানে বিক্রি কমবে। আমপান পরবর্তী সুন্দরবনের অর্থনীতিতে ইতিমধ্যেই তেমন লক্ষণ দেখা দিচ্ছে।
অনেক আগে থেকে সতর্কতা জারি হওয়ায় বোরো ধানের বেশিরভাগই বাঁচানো গিয়েছে। কিন্ত বাঁচানো যায়নি আনাজ। রক্ষা পায়নি আম-কলা-পেঁপে-সহ বিভিন্ন ফল। নষ্ট হয়েছে ফুল। পান বরজের ক্ষতি সাঙ্ঘাতিক। বসিরহাটের আটকড়িয়া গ্রামের আবদুর রজ্জাক জানান, ঝড়ে তাঁর তিনটি আম বাগান তছনছ হয়ে গিয়েছে। সব মিলিয়ে ক্ষতি কয়েক লক্ষ টাকা। আবদুর ঋণ রয়েছে ব্যাঙ্কে। তিনি চাইছেন প্রাকৃতিক দুর্যোগের জন্য সেই ঋণ মকুব করুক সরকার।
এ বারের ঝড়ে সুন্দরবন এলাকার বাইরেও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বনগাঁ মহকুমার অর্থনীতির মূল ভিত্তিই হল কৃষি। আমপানে কৃষি ব্যবস্থা কার্যত তছনছ হয়ে গিয়েছে। একে তো নোনা জলে ডুবেছে বহু জমি। যেটুকু যা অক্ষত, সেখানে নতুন করে চাষ শুরু করার মতো অনেকের হাতে নেই।
ছয়ঘরিয়া পঞ্চায়েত এলাকার রমেশ গায়েন জানান, আড়াই বিঘে জমিতে তিল এবং সাড়ে তিন বিঘে জমিতে ধান ছিল। সব নষ্ট হয়ে পথে বসেছেন তিনি। তাঁর কথায়, “৩০ হাজার টাকা কৃষি ঋণ। মকুব না হলে আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারব না।”
ক্যানিং, বাসন্তী, গোসাবা এলাকার সিংহভাগ কৃষিজমি নোনাজল ঢুকে ক্ষতিগ্রস্ত। কৃষকবন্ধু প্রকল্পের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে চাষিকে। তবে কৃষি ঋণ মকুবের বিষয়ে এখনও কোনও সিদ্ধান্ত মহকুমা বা ব্লক স্তরে আধিকারিকদের জানানো হয়নি।
এই এলাকায় বহু মানুষ পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত। পর্যটনের ব্যবহৃত প্রচুর লঞ্চ, ভুটভুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। পর্যটন কেন্দ্রগুলি খুলতে থাকলেও পর্যটক হাতে গোনা। বহু মানুষ মুরগি খামারের ব্যবসায় জড়িত। ক্ষতি হয়েছে সেগুলিরও। কোনও ক্ষতিপূরণ পাননি বলে জানিয়েছেন অনেকেই।
জয়নগর এলাকায় লিচু, সবেদা-সহ বাণিজ্যিক ভাবে চাষ হয় নানা ধরনের ফলের। বহু বাগান তছনছ হয়ে গিয়েছে। বাগান মালিকেরা কোনও ক্ষতিপূরণ পাননি বলে জানিয়েছেন।
কাকদ্বীপ, সাগর, নামখানা, ও পাথরপ্রতিমার ছবিটা আলাদা কিছু নয়। তবে ধানের পরেই এলাকার অর্থকরী ফসল পান। চারটি ব্লক ৫০ হাজারেরও বেশি পান বরজ পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এক মাস পরেও সরকারি ক্ষতিপূরণ পাননি বলে জানিয়েছেন অধিকাংশ পান চাষি। ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি কৃষি ঋণ মকুবের দাবি জানান পান চাষিরা। এই এলাকার বহু চাষি মহাজনদের কাছে ঋন নেন। মাথায় হাত পড়েছে তাঁদের।
বসিরহাটের কয়েক হাজার পোশাক তৈরির পেশার সঙ্গে জড়িত। লকডাউনের পর থেকে কার্যত বেকার হয়ে পড়েন তাঁরা। অনেকে চাষের জমিতে দিনমজুরি শুরু করেছিলেন। দেভোগ গ্রামের খালেক গাজি, ওয়াহাব মণ্ডল বলেন, “পোশাক কারখানা কবে চালু হবে জানি না। এখন আর জমিতেও কাজ পাব না। কী করে যে চলবে আমাদের। ঘূর্ণিঝড়ে সব শেষ হয়ে গেল আমাদের।” গ্রামের হাট থেকে আনাজ কিনে শিয়ালদহে বেচতেন হাড়োয়ার রবিউল গাজি। বললেন, “আনাজ কোথায় যে কিনব!” বড় বাজার থেকে মনোহারি দ্রব্য কিনে বসিরহাটের দোকানে সরবরাহ করেন গোবিন্দ বিশ্বাস। তিনি বলেন, “ঝড়ের পর থেকে দোকানগুলিতে কোনও চাহিদাই নেই। চাষিদের হাতে পয়সা কোথায় যে কিনবে।” গ্রামের টোটো-অটো-ভ্যান রিকশা চালক, ছোট দোকানি— অনেকেই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ঋণ নিয়ে টোটো-অটো কিনে মাসিক কিস্তি দিতে পারছেন না।
লকডাউনে এমনিতেই ভুক্তভোগী এঁরা। আমপান যে ভাবে গ্রামীণ অর্থনীতি দুমড়ে-মুচড়ে দিল, তাতে কবে পরিস্থিতি ফিরবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় গ্রামীণ বাংলা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy