ভোগান্তির যাতায়াত।—নিজস্ব চিত্র।
ছেলের বাড়ি কাকদ্বীপে। সেখানে যাওয়ার জন্য মেদিনীপুর থেকে সাতসকালে বেরিয়েছিলেন সুভাষিণী মান্না। খেয়া পেরিয়ে নুরপুর দিয়ে কোনও রকমে পৌঁছেছিলেন ডায়মন্ড হারবার বাসস্টপে। তখনও জানতেন না, রাস্তায় দুর্ভোগ অপেক্ষা করে রয়েছে তার জন্য। প্রায় দেড় ঘণ্টা অপেক্ষার পরে পেলেন কাকদ্বীপ যাওয়ার ছোট গাড়ি।
শুধু সুভাষিণীদেবীই নন। সোমবার, সপ্তাহের প্রথম কাজের দিনই ডায়মন্ড হারবার এবং কাকদ্বীপ মহকুমার ১৭টি রুটে বাস ধর্মঘটের জেরে ভুগতে হল অসংখ্য মানুষকে। রাস্তায় সরকারি বাসের দেখা সে ভাবে মেলেনি। পড়ুয়ার অভাবে মার খেয়েছে অনেক স্কুলের পড়াশোনা। বেআইনি অটো, ট্রেকার-সহ ছোট গাড়িতে যাত্রী পরিবহণের বিরুদ্ধে দু’দিনের ডাকা বাস ধর্মঘট অবশ্য প্রশাসনের আশ্বাসে বিকেলেই প্রত্যাহার করে নেয় বাস-মালিক সংগঠন। তবে, রাতেও সে ভাবে রাস্তায় বাস নামতে দেখা যায়নি।
বাস-মালিকদের সংগঠনের তরফে এ দিন ডায়মন্ড হারবারের মহকুমাশাসক শান্তনু বসুর কাছে অভিযোগ জানানো হয়। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অশোক রায় বলেন, ‘‘প্রশাসন আশ্বাস দিয়েছে বলে ধর্মঘট তুলছি। তবে, আমরা এ বারই শেষবারের মতো দেখব। সুরাহা না হলে লাগাতার আন্দোলনের পথে যাব।’’ মহকুমাশাসক শান্তনু বসু বলেন, ‘‘অভিযোগ পেয়েছি। যাতে ধারাবাহিক ভাবে বেআইনি গাড়িগুলির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যায়, তার ব্যবস্থা প্রশাসন করবে।’’ একই আশ্বাস শোনা গিয়েছে কাকদ্বীপের মহকুমাশাসক অমিত নাথের গলাতেও। আরটিও চপল বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অভিযোগ পেয়েছি। যতটা সম্ভব অভিযান চালাব। বাস মালিকদের অনুরোধ যখন তখন এ ভাবে ধর্মঘট করে সাধারণ মানুষকে বিপদে ফেলবেন না।’’ জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত জেলার এই দুই মহকুমায় একই কারণে দফায় দফায় বাস ধর্মঘট হয়েছে। জেলার বাস-মালিকদের সংগঠন, ‘জয়েন্ট কমিটি অব বাস অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর তরফে অভিযোগ আনা হয়েছে, ছোট গাড়িগুলি লম্বা রুটে যাত্রী তুলে তাদের ব্যবসায় থাবা বসাচ্ছে। ওই সব ছোট গাড়ির কোনও লাইসেন্স বা বৈধ কাগজপত্র নেই। ওই সব গাড়ির সংখ্যা এক বছরে লাফিয়ে বেড়েছে। এখন দুই মহকুমায় দু’হাজারেরও বেশি এ রকম গাড়ি চলছে।
বাস-মালিকদের অভিযোগ, ডায়মন্ড হারবার থেকে শুরু করে সরিষা, কামারপোল-সহ দক্ষিণ বিষ্ণুপুর এবং কাকদ্বীপের বেশ কিছু গ্যারাজে প্রতিদিনই পণ্যবাহী ছোট গাড়ির খোলনলচে যাত্রিবাহী গাড়িতে পরিণত করা হচ্ছে। তার পরেই সেগুলি রাস্তায় নেমে পড়ছে। এ ব্যাপারে পুলিশ প্রশাসনের নজরদারি নেই। কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে এ নিয়ে রফাও হয় বলে অভিযোগ।
যদিও জেলার অতিরিক্ত পুলিশ (পশ্চিম) সুপার অর্ণব বিশ্বাস জানান, টাকা দিয়ে ব্যবসা চলে এ রকম কোনও অভিযোগ পাইনি। বেআইনি গাড়ির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথা জেলা পরিবহণ দফতরের। তারা চাইলে পুলিশের পক্ষ থেকে সাহায্য করা হয়। এ দিন দুই মহকুমা থেকে ছাড়া রায়দিঘি, পাথরপ্রতিমা, কাকদ্বীপ, ডায়মন্ড হারবার, নামখানা থেকে হাওড়া এবং দিঘার মতো রুটে বাস চলেনি। চলেনি অপেক্ষাকৃত কম দূরত্বের মিনিবাসও। তার জেরে সমস্যায় পড়েন বিজয়গঞ্জ, কুলপি, মথুরাপুর, বুরুল, ফলতা, জয়নগর, নৈনান, লক্ষ্মীকান্তপুর, বিজয়গঞ্জের মতো এলাকার কয়েক লক্ষ মানুষ।
দীর্ঘ ছুটির পর এ দিন খুললেও বাস ধর্মঘটের জেরে পঠন-পাঠন শিকেয় ওঠে অনেক স্কুলেই। কাকদ্বীপের গণেশপুর ছায়াসুন্দরী বিদ্যানিকেতন, বীরেন্দ্র বিদ্যানিকেতন, শিশু শিক্ষায়তনের মতো স্কুল ছাড়াও ডায়মন্ড হারবার হাইস্কুল, সরিষা হাইস্কুলের মতো বেশ কিছু স্কুলে মূলত নিচু ক্লাসের ছাত্র উপস্থিতির হার কম ছিল। বাসের অপেক্ষায় ডায়মন্ড হারবার বাসস্টপে দাঁড়ানো এক প্রৌঢার ঘামেভেজা বলিরেখা ছাপিয়ে বের হচ্ছিল বিরক্তি। তাঁর কথায়, ‘‘হঠাৎ করে রাস্তা থেকে এ রকম বাস তুলে নিলে আমরা কী ভাবে যাব?’’ বেহালা থেকে হটুগঞ্জ এসেছিলেন রুমা হালদার। তাঁর অভিজ্ঞতাও একই রকম। দীর্ঘ পথের অনেকটাই বার বার গাড়ি পাল্টাতে হাঁফিয়ে গিয়েছেলন তিনি। ধর্মঘটের কারণ শোনার পর রুমাদেবীর ক্ষোভ, ‘‘কেন প্রশাসন ব্যবস্থা নেয় না এদের বিরুদ্ধে। আমাদেরই বলি হতে হয় কেন?’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy