কখনও মোটরবাইকে চড়ে এসে দুষ্কৃতীরা প্রকাশ্যে গুলি করে খুন করে পালিয়ে যাচ্ছে। কখনও দোকানের মধ্যে ঢুকে গুলি করে খুনের ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশ থেকে রাতের অন্ধকারে দুষ্কৃতীরা ঢুকে ট্রাকের মালপত্র চুরি করে পালাচ্ছে। অবাধে চলছে সোনা-মাদক পাচার। তোলাবাজি, চুরি-ছিনতাইয়ের ঘটনা তো লেগেই আছে।
সব মিলিয়ে গত কয়েক বছরে দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর পেট্রাপোলের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হচ্ছে বারবারই।
বুধবার বিকেলে পেট্রাপোল বন্দরের নিরাপত্তা খতিয়ে দেখতে এসেছিলেন রাজ্য পুলিশের আইজি (দক্ষিণবঙ্গ) অজয় রানাডে এবং ডিআইজি (পিআর) সুব্রত মিত্র। সঙ্গে ছিলেন জেলা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ভাস্কর মুখোপাধ্যায়, বনগাঁর এসডিপিও বিশ্বজিৎ মাহাতো। তাঁরা বন্দর এলাকার নির্মীয়মাণ সুসংহত চেকপোস্ট এলাকা ঘুরে দেখেন। ৮৪ একর জমির উপর তৈরি হচ্ছে ওই চেকপোস্ট। অগস্ট মাসে যা তৈরির কাজ শেষ হয়ে যাওয়ার কথা।
নো ম্যানন্স এলাকাও এ দিন ঘুরে দেখেন প্রতিনিধি দলের সদস্যেরা। তবে কোনও মন্তব্য করেননি কেউই। জেলা পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, নতুন সুসংহত চেকপোস্ট এলাকায় এবং সার্বিক ভাবে পেট্রাপোল এলাকার নিরাপত্তা ব্যবস্থাই এ দিন খতিয়ে দেখেছেন পুলিশ কর্তারা। কী ভাবে বন্দর এলাকার নিরাপত্তা আরও বাড়ানো যায়, সে ব্যাপারেও খোঁজ-খবর করেছেন।
বন্দরে কাজের সূত্রে আসা প্রতিটি মানুষই জানেন, এখানে বেআইনি কাঁচা টাকা উড়ছে। ওই টাকার দখল নিজেদের অনুকূলে রাখতে দুষ্কৃতীরা সক্রিয়। তার জেরে গুলি-বোমাবাজির ঘটনা নতুন নয়। বাইরে থেকে দুষ্কৃতীরা এখানে এসেও তোলাবাজি করছে বলে অভিযোগ। ধুর পাচারের (বেআইনি ভাবে দু’দেশের মধ্যে যাতায়াত করা) ঘাটের দখল নিয়েও দুষ্কৃতীদের মধ্যে বিরোধ লেগে থাকে। বন্দরের দখল নিজেদের হাতে রাখতে পারলেই কোটিপতি হওয়াটা শুধু সময়ের অপেক্ষা— সে কথা এলাকার ছেলেবুড়োরাও বিলক্ষণ জানে। আর এ সব নানা অনৈতিক কাজের পিছনে রাজনৈতিক দলের মদত থাকে বলেও অভিযোগ ওঠে।
বনগাঁয় উল্লেখযোগ্য শিল্প বলতে কিছুই নেই। এখানকার বহু মানুষের রুজি-রুটি জড়িয়ে আছে বন্দরের সঙ্গেই। দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতি দিন শ’য়ে শ’য়ে পণ্য-বোঝাই ট্রাকে চালক খালাসিরা বন্দরে আসেন। রাতে তাঁরা ট্রাকেই বিশ্রাম নেন। বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত মানুষ ছাড়াও বিভিন্ন ব্যবসায় যুক্ত অনেকে এখানে আসেন। বাংলাদেশ এবং এ দেশের মধ্যে পাসপোর্ট-ভিসা নিয়েও রোজ বহু মানুষ যাতায়াত করেন। ঢাকা-কলকাতা সরকারি বাসও এখান দিয়ে যাতায়াত করে। বন্দর সূত্রের খবর, সব মিলিয়ে রোজ পেট্রাপোল বন্দরে হাজার দ’শেক মানুষের যাতায়াত।
অথচ বন্দরে আসা-যাওয়া করা মানুষের নিরাপত্তা বলতে তেমন কিছুই গড়ে ওঠেনি। পেট্রাপোল ক্লিয়ারিং এজেন্ট স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের সম্পাদক কার্তিক চক্রবর্তীর কথায়, ‘‘বন্দর এলাকায় আমাদের মতো সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা বলতে কিছুই নেই। প্রকাশ্যে দুষ্কৃতীরা আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে ঘোরাঘুরি করছে। খুন-ছিনতাই-চুরি লেগেই আছে। অবিলম্বে এখানে ব্যবসায়ী এবং সাধারণ মানুষের স্বার্থে পোর্ট থানা তৈরির দাবি আমরা বহু দিন ধরে জানিয়ে এলেও আজও তা তৈরি হল না।’’ বন্দরে দীর্ঘ দিন ধরেই মুদ্রা বিনিময়ের কারবারে যুক্ত এক ব্যক্তির কথায়, ‘‘অনেক সময়েই নগদ টাকা নিয়ে যাতায়াত করতে হয়। টাকা ভর্তিব্যাগ ছিনতাইয়ের ঘটনা আগেও ঘটেছে। সব সময়ে ভয়ে ভয়ে থাকি।’’
বন্দরের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত অনেকেরই দাবি, পূর্ণাঙ্গ থানা যত দিন না হচ্ছে, অন্তত একটি ফাঁড়ি যেন তৈরি করা হয়। বন্দর সূত্রে জানা গিয়েছে, দীর্ঘ দিন ধরেই এখানে একটি পোর্ট থানা তৈরির পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা চলছে রাজ্যের সঙ্গে।
বনগাঁ থানা থেকে পেট্রাপোল বন্দরের দূরত্ব ৫ কিলোমিটার। বন্দর এলাকায় কোনও পুলিশ থাকে না। আইন-শৃঙ্খলার সমস্যা হলে বনগাঁ থানা থেকে পুলিশ যত ক্ষণে এসে পৌঁছয়, তত ক্ষণে অপরাধীরা পগারপাড়। বন্দর-সংলগ্ন এলাকায় বিএসএফের দু’টি ক্যাম্প রয়েছে। তবে জওয়ানেরা শুধুমাত্র সীমান্ত লাইনেই টহল দেন। বন্দরে কী ঘটছে, তা নিয়ে তাঁদের বিশেষ মাথাব্যথা নেই। বন্দর এলাকার মধ্যে থাকা সেন্ট্রাল ওয়্যারহাউস কর্পোরেশনের (সরকারি ট্রাক টার্মিনাস) ট্রাক মধ্যে পণ্য-বোঝাই সার সার ট্রাক দাঁড়িয়ে থাকে। রাতের অন্ধকারে দুষ্কৃতীরা সেখানে মালপত্র চুরি করে পালায়। ট্রাক থেকে পণ্য চুরি হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পুলিশে অভিযোগই হয় না। কারণ, পুলিশে অভিযোগ করলে পুলিশের পক্ষ থেকে জানানো হয়, যত ক্ষণ না তদন্তে শেষ হচ্ছে, ট্রাক বেনাপোল বন্দরে নিয়ে যাওয়া যাবে না। কিন্তু ট্রাক দীর্ঘ দিন দাঁড় করিয়ে রাখাটা সম্ভব হয় না ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy