এ কথা ভাবলে ভুল হবে যে, ডায়মন্ড হারবারের ইতিহাস বড় জোর মুঘল আমলের সমবয়স্ক। টলেমির রচনায় উল্লেখিত পালৌরা বা পালুরা বন্দরটির অবস্থান ছিল সম্ভবত ডায়মন্ড হারবারের অদূরে আব্দালপুর গ্রামে।
ডায়মন্ড হারবারের হুগলি নদী। —নিজস্ব চিত্র।
হুগলি নদীর তীরের ডায়মন্ড হারবার দক্ষিণ ২৪ পরগনার একটি অন্যতম ইতিহাস-প্রসিদ্ধ জায়গা। সম্ভবত অঞ্চলটির আদি নাম ছিল চিংড়িখালি। হুগলি নদীর সঙ্গে সংযুক্ত খাল বা খাঁড়িতে প্রচুর চিংড়ি পাওয়া যেত বলেই এমন নাম হতে পারে। কেউ কেউ মনে করেন এই অঞ্চলের অন্যতম বাসিন্দা চোয়াড় জনজাতির জাতিনাম লোকমুখে বিকৃতি লাভ করে চিংড়ি শব্দে পরিবর্তিত হয়েছে। কালের বিবর্তনে চিংড়িখালি একদা হাজিপুর নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এখনও বয়স্ক লোকজন হাজিপুর নামটি বলতেই ভালবাসেন।
এই নাম পরিবর্তনের পিছনে ছোট্ট ইতিহাস আছে। এক সময় বিভিন্ন জায়গার হজযাত্রীরা এখানকার হুগলি নদী তীরবর্তী মছলন্দ পীরের দরগায় বিশ্রাম নিয়ে জাহাজে চাপতেন। এই দরগাটি আদিকালের কৌলীন্য হারিয়ে ফেললেও এখনও তার প্রায় প্রাচীন রূপটি ধরে রেখেছে। প্লেগের প্রাদুর্ভাবের কারণে হজ থেকে ফেরা যাত্রীদের জাহাজ থেকে নামিয়ে এখানে ১৪ দিনের কোয়রান্টিনে রাখা হত। হজযাত্রীদের আনাগোনার কারণে কালক্রমে চিংড়িখালি নামের উপর চেপে বসে হাজিপুর নামটি।
তবে ইংরেজরা বিভিন্ন নথিপত্রে জায়গাটিকে ‘ডায়মন্ড হারবার’ নামে চিহ্নিত করে। বন্দর বলে ‘হারবার’, কিন্তু ‘ডায়মন্ড’ কেন? এই প্রশ্নের তেমন কোনও উত্তর আমার হাতে নেই। তবে এই নামকরণের কারণ হিসাবে একটা অপেক্ষাকৃত যুক্তিযুক্ত উত্তর পাওয়া যায়। এই অঞ্চলে প্রচুর লবণ উৎপাদিত হত। সেই উৎপাদিত লবণ নদী তীরবর্তী অঞ্চলে জড়ো করে রাখা হত। সেই চূড়াকৃত লবণস্তূপের উপর রোদ পড়ে হিরের মতো ঝকমক করে উঠত। তাই এমন নাম।
১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে কোম্পানির গেজেটিয়ার লিখছে, ‘At Diamond Harbour the Company’s ships usually unload their outward and receive the greater part of their homeward bound cargoes from whence they proceed to Sagar roads where the remainder is taken in.’ বোঝা যায় তত দিনে জায়গাটি বন্দর হিসাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে।
ইংরেজরা ১৮৫১ সালেই ডায়মন্ড হারবারের সঙ্গে কলকাতার টেলিগ্রাফ যোগাযোগ গড়ে তোলে। এটাই ভারতের প্রথম টেলিগ্রাফ-ব্যবস্থা। চিংড়িখালি তথা হাজিপুরের যতই সম্ভাবনা থাক না কেন, পর্তুগিজ ও মগ জলদস্যুদের অবাধ বিচরণ সেই সম্ভাবনাকে সমূলে বিনাশ করছিল। জলদস্যুদের হাত থেকে বাণিজ্যবহরগুলি রক্ষা করার জন্য কোম্পানি ১৮৬৮-৬৯ খ্রিস্টাব্দে একটি ইট ও পাথরের দুর্গ নির্মাণ করে। এই দুর্গটি বিভিন্ন নথিতে ‘চিংড়িখালি ফোর্ট’ নামে চিহ্নিত।
যদিও জনশ্রুতি অনুযায়ী দুর্গটি নির্মাণ করেছিল পর্তুগিজরা, কিন্তু তার সপক্ষে কোনও লিখিত তথ্য পাওয়া যায় না। এমনও হতে পারে, যে জায়গায় দুর্গটি নির্মিত হয়েছিল সেখানকার খাঁড়ি-জঙ্গলে ছিল পর্তুগিজদের আস্তানা এবং ইংরেজরা তাদের তাড়িয়ে সেখানেই বানিয়েছিল পোক্ত দুর্গ। স্থানীয় মানুষ নৌবাহিনীর অপেক্ষাকৃত নবীন কেল্লাটির সঙ্গে তুলনা করে দুর্গটিকে ‘পুরাতন কেল্লা’ নাম দিয়েছিলেন। এখন কেবল নামটুকু ছাড়া সেই ‘পুরাতন কেল্লা’-র কোনও চিহ্ন নেই বললেই চলে।
১৮৫৭-র দিকে ইংরেজরা ডায়মন্ড হারবারকে সাবডিভিশন-সদর হিসাবে ঘোষণা করে। সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসাবে ডায়মন্ড হারবারে এসে কিছু দিন কাটিয়ে গিয়েছিলেন। ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে ইস্টার্ন বেঙ্গল রেলওয়েজ ডায়মন্ড হারবার থেকে বারুইপুর পর্যন্ত রেল চলাচলের ব্যবস্থা করে। এর অনেক আগেই উনিশ শতকের গোড়ার দিকে ডায়মন্ড হারবার থেকে কলকাতা পর্যন্ত ঘোড়ায় টানা গাড়ি চলার জন্য প্রশস্ত সড়ক নির্মিত হয়েছিল। ১৮৮৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ডায়মন্ড হারবার হাইস্কুল, ১৯০০ সালে ডায়মন্ড হারবার গার্লস হাইস্কুল। ১৯৩০ সালে গাঁধীজির নেতৃত্বে শুরু হওয়া লবণ সত্যাগ্রহ আন্দোলনের সুগভীর প্রভাব পড়েছিল ডায়মন্ড হারবারের জনজীবনের উপর। নেতৃত্ব দিয়েছিলেন আইনজীবী চারুচন্দ্র ভান্ডারী। তাঁর উদ্যোগে গড়ে উঠেছিল ‘খাদিমন্দির’, এখনও যার ক্ষীণ অস্তিত্ব বিদ্যমান।
এ কথা ভাবলে ভুল হবে যে, ডায়মন্ড হারবারের ইতিহাস বড় জোর মুঘল আমলের সমবয়স্ক। টলেমির রচনায় উল্লেখিত পালৌরা বা পালুরা বন্দরটির অবস্থান ছিল সম্ভবত ডায়মন্ড হারবারের অদূরে আব্দালপুর গ্রামে। কারও কারও অনুমান, পালৌরা বা পালুরা নাম থেকেই নিকটস্থ গ্রামটির নাম হয়েছে ‘পারুল’। আব্দালপুর সন্নিহিত বিভিন্ন স্থান থেকে গুপ্তযুগের বিভিন্ন প্রত্নসামগ্রী পাওয়া গিয়েছে। এখান থেকে পাওয়া ১১৫৪টি প্রস্তরায়ুধ ছাড়াও বিভিন্ন আকৃতির মাটির পাত্র, পোড়ামাটির মূর্তি, পোড়ামাটির লিপিফলক ইত্যাদি রাজ্য প্রত্নতত্ত্ব সংগ্রহশালায় গৃহীত হয়েছে। স্থানীয় এক জন প্রত্ন সংগ্রাহকের নিজস্ব সংগ্রহশালায়ও অনেক অমূল্য প্রত্নসামগ্রী সংরক্ষিত আছে। আব্দালপুরের নদী তীরবর্তী দেউলপোতায় একটি প্রাচীন বটের তলায় রয়েছে সুপ্রাচীন দেউল। এখান থেকে পাওয়া একটি কালো পাথরের ভগ্নাংশ শিবলিঙ্গ হিসাবে এখন পূজিত হয়। বছর পাঁচেক আগে এখানে প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননে বেশ কিছু নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে।
ডায়মন্ড হারবার এখন অতীতের ছায়া মুছে নিজেকে যথেষ্ট আধুনিক করে তুলেছে। ১৯৮২ সালে পুরসভা গঠনের মাধ্যমে ডায়মন্ড হারবারকে পঞ্চায়েতি ত্রিস্তর ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করা হয়। প্রথম নির্বাচনে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন বামফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী যথাক্রমে অসিত বসু ও মৃণাল দত্ত। বিভিন্ন সুযোগসুবিধা সুলভ হওয়ায় এবং রেল ও সড়ক পথে সহজে কলকাতায় পৌঁছনোর ব্যবস্থা থাকায় বিভিন্ন দূরবর্তী গ্রামাঞ্চল থেকে লোকজন ডায়মন্ড হারবারে ভিড় জমাতে থাকেন। দূরবর্তী স্থান থেকে চাকরিসূত্রে আসা মানুষেরাও স্থায়ী বাসিন্দা হয়ে ওঠেন।
ক্রমশ একটি নিতান্ত সাদামাটা চুপচাপ মফসসল হয়ে ওঠে সপ্রতিভ ও মুখর। আজ প্রায় চার দশক পরে ডায়মন্ড হারবার পুরসভা ১৬টি ওয়ার্ড নিয়ে অনেকটাই সমুজ্জ্বল। এখন ডায়মন্ড হারবারে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল, মেডিক্যাল কলেজ, ঢাউস ঢাউস শপিংমল, সিনেমা হল, কয়েক গন্ডা স্লিম জিম কী নেই! ডায়মন্ড হারবারের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলও যথেষ্ট সমৃদ্ধ। লিটল ম্যাগাজিন, গ্রুপ থিয়েটার, গানের দল সব কিছুই আছে। আছেন কিছু প্রথিতযশা শিল্পী, কবি ও সাহিত্যিক। সব মিলিয়ে হুগলি নদীর শীতল সান্নিধ্যে থাকা দক্ষিণের সুন্দর শহর ডায়মন্ড হারবার এখন পুরোপুরি বন্দর নগরী।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy