Advertisement
২৬ নভেম্বর ২০২৪
Royal Bengal Tiger

মাকে আর জঙ্গলে পাঠাতে চান না ছেলে

মঙ্গলবার সুন্দরবনের ঝিলা ২ নম্বর জঙ্গলের চিলমারি খালের কাছে বাঘের আক্রমণে মৃত্যু হয় মাঝবয়সী দুর্গাপদর। লাঠিসোঁটা দিয়ে বাঘের সঙ্গে লড়াই করে স্বামীকে উদ্ধার করে নিয়ে এলেও বাঁচাতে পারেননি সন্ধ্যা। 

শোকার্ত: দুর্গাপদ মণ্ডলের স্ত্রী সন্ধ্যা। নিজস্ব চিত্র

শোকার্ত: দুর্গাপদ মণ্ডলের স্ত্রী সন্ধ্যা। নিজস্ব চিত্র

নিজস্ব সংবাদদাতা
গোসাবা শেষ আপডেট: ২৪ জানুয়ারি ২০২০ ০০:৫৩
Share: Save:

মাঝে মধ্যেই প্রলাপ বকছেন। কখনও ডুকরে কেঁদে উঠছেন। আর এর মধ্যেই বলে চলেছেন একটা কথা, ‘‘যত কষ্টই হোক, জঙ্গলে আর যাব না।’’বাঘের আক্রমণে স্বামী দুর্গাপদ মণ্ডলকে হারিয়ে এমনই অবস্থা স্ত্রী সন্ধ্যার।

মঙ্গলবার সুন্দরবনের ঝিলা ২ নম্বর জঙ্গলের চিলমারি খালের কাছে বাঘের আক্রমণে মৃত্যু হয় মাঝবয়সী দুর্গাপদর। লাঠিসোঁটা দিয়ে বাঘের সঙ্গে লড়াই করে স্বামীকে উদ্ধার করে নিয়ে এলেও বাঁচাতে পারেননি সন্ধ্যা।

স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মঙ্গলবার ভোরে ডিঙি নৌকো নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলেন সুন্দরবনের বাগনা রেঞ্জের অন্তর্গত চিলমারি খালের দিকে। সন্ধ্যা জানান, সকাল ৬টা নাগাদ সেখানে পৌঁছে খাঁড়ির মধ্যে নৌকো নোঙর করে তাঁরা ‘দোন’ বা ফাঁদ পেতেছিলেন কাঁকড়া ধরার জন্য। দুর্গাপদ নৌকোর এক মাথায় বসেছিলেন। অন্য দিকে ছিলেন সন্ধ্যা।

অতর্কিতে জঙ্গলের মধ্যে থেকে বাঘ বেরিয়ে লাফিয়ে পড়ে দুর্গাপদর উপরে। থাবা বসায় গলায়। টাল সামলাতে না পেরে দুর্গাপদকে নিয়ে পড়েও যায় খাঁড়ির জলে।

হকচকিয়ে গেলেও সন্ধ্যা বুঝে যান, মাথা ঠান্ডা রেখে কিছু একটা করতে না পারলে স্বামীকে ফিরিয়ে আনতে পারবেন না। সাহসে ভর করে নৌকোর লগি দিয়েই বাঘের পিঠে মারতে থাকেন বছর বেয়াল্লিশের সন্ধ্যা। হুঙ্কার ছাড়তে থাকে বাঘ। দুর্গাপদকে তখনও ছাড়েনি। হাঁচরপাঁচড় চলতে থাকে। একটা সময়ে রণে ভঙ্গ দেয় রয়ালবেঙ্গল। দুর্গাপদকে ছেড়ে প্রবল গজরাতে গজরাতে জঙ্গলে গা ঢাকা দেয়।

নদীর জল থেকে রক্তাক্ত অবস্থায় স্বামীকে কোনও মতে নৌকোয় তোলেন সন্ধ্যায়। ভয়ে, উত্তেজনায় সারা শরীর তখন কাঁপছে মহিলার। কান্নাও বাঁধ মানছে না। অন্য মানুষটাও তখন যন্ত্রণায় গোঙাচ্ছেন।

ওই অবস্থায় স্বামীকে নিয়ে দাঁড় বাইতে শুরু করেন সন্ধ্যা। একটা সময়ে নিস্তেজ হয়ে আসে স্বামীর দেহটা। সন্ধ্যা বুঝে নেন, শেষরক্ষা হয় তো হল না!

একা হাতে দীর্ঘক্ষণ দাঁড় টেনে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত মহিলা ফেরেন গ্রামে। নৌকোর খোল তখন জলে-কাদায়-রক্তে মাখামাখি। দুর্গাপদকে গ্রামের লোকজন আর হাসপাতালে নেওয়ার দরকার মনে করেননি। শরীর ততক্ষণে অসাড়। গ্রামের সৎকার করা হয় দেহ। ঘটনার পরে দু’দিন কেটে গেলেও এখনও বাড়ির দাওয়ায় বসে ডুকরে ডুকরে কাঁদছেন সন্ধ্যা। স্বামীকে বাঁচাতে না পারায় ক্ষোভও উগরে দিচ্ছেন কখনও কখনও। সন্ধ্যা বলেন, “অনেক চেষ্টা করলাম, কিন্তু বাঁচাতে পারলাম না। জঙ্গল আমার সব কেড়ে নিল। ভিক্ষা করে খেতে হলেও আর যাব না জঙ্গলে।’’ গ্রামের মানুষ বলছেন, ‘‘বেহুলার মতো স্বামীর দেহ এত দূর টেনে আনলেন স্ত্রী। কিন্তু তবু প্রাণ তো ফিরল না!’’

দম্পতির দুই সন্তান। বছর কয়েক আগে এক মেয়ের বিয়ে হয়েছে। ছেলে তন্ময় মণ্ডল কেরলে দিনমজুরি করেন। বাবার মৃত্যুর খবর পেয়ে বাড়ি ফিরেছেন। মাকে মন শক্ত করতে বলছেন বছর বাইশের তরুণ। মাকে তিনিও আর যেতে দিতে চান না জঙ্গলে। বললেন, “এলাকায় সে ভাবে কিছু কাজ না থাকায় আমি ভিনরাজ্যে কাজ করি। কিন্তু যাঁরা গ্রামে থাকেন, তাঁরা পেটের টানেই জঙ্গলে যান। বাবা-মা সে জন্যই এত বছর ধরে এই কাজ করছেন। কিন্তু আর না। যথেষ্ট হয়েছে। জঙ্গল আমার বাবাকে কেড়ে নিল। মাকে হারাতে চাই না।’’

অন্য বিষয়গুলি:

Royal Bengal Tige Sundarban
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy