ভেজাল: বাজেয়াপ্ত করা ঘি। ফাইল চিত্র
বিভিন্ন সংস্থার নাম দিয়ে স্টিকার মেরে বাজারে দেদার বিক্রি হচ্ছে ভেজাল ঘি —এমনই সব তথ্য উঠে আসছে পুলিশের হাতে।
শুক্রবার উত্তর ২৪ পরগনার মছলন্দপুরে একটি ভেজাল ঘিয়ের কারবারের হদিস পেয়েছে পুলিশ। কিন্তু এ কোনও নতুন ঘটনা নয়। বনগাঁ, বসিরহাট, বারাসত মহকুমায় এখন রমরমিয়ে চলছে ভেজাল ঘিয়ের কারবার। পুলিশ জানিয়েছে, বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা গিয়েছে, ওই সব সংস্থার কোনও অস্তিত্ব থাকে না। কারণ, কোনও নাম স্টিকার হিসাবে ব্যবহার করতে হলে ‘কপিরাইট রেজিষ্ট্রেশন’ করাতে হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তা থাকে না। মুদি-মিষ্টির দোকানে গেলেই পাওয়া যায় ঘি। অভিযোগ, ওই সব ঘি কোথায় তৈরি হয়, কোথা থেকে আসছে, সংস্থাটি ভুয়ো কিনা— ক্রেতারা তা খোঁজ না নিয়েই ঘি কিনে বাড়ি ফেরেন। আলগা গন্ধে ধরে নেন, ভাল ঘি-ই কিনেছেন। মানুষের সচেতনতার অভাবের সুযোগ নিয়ে ভেজাল ঘি বিক্রির কারবার ফুলে ফেঁপে উঠেছে বলেও মনে করছে পুলিশ।
অতীতে বনগাঁ থানার পুলিশ ৩২০ কেজি ভেজাল ঘি আটক করেছিল। নদিয়ার শান্তিপুর থেকে গাড়ি করে ওই ভেজাল ঘি আনা হচ্ছিল বনগাঁ শহরে। ওই ঘি-তে বনস্পতি, রিফাইন তেল, বাটার ওয়েল মেশানো হয়েছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে।
ভেজাল চিনবেন কী করে
• কিছুটা ঘি হাতের তালুতে নিয়ে ঘষে নিন। তারপর শুঁকে দেখুন। যদি কিছুক্ষণ পরে গন্ধ উবে যায়, তা হলে বুঝবেন সেটা ভেজাল ঘি। কারণ আসল ঘিয়ের গন্ধ অনেকক্ষণ পর্যন্ত হাতে থেকে যায়। এমনকী শুধু জল দিয়ে হাত ধুয়ে ফেলার পরেও।
• হাতের তালুতে এক চামচ ঘি নিন। যদি ঘি গলতে শুরু করে, তবে তা খাঁটি। সাধারণত খাঁটি ঘি শরীরের তাপমাত্রায় গলতে থাকে।
• এক চামচ ঘি নিয়ে গরম করতে থাকুন। যদি দ্রুত গলে যায় এবং বাদামী বর্ণ ধারণ করে তবে তা খাঁটি। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই খাঁটি ঘি গলে যায়। ঘি ভেজাল হলে গলতে সময় নেয়।
• সন্দেহ হলে অনেকটা ঘি একটি পাত্রে নিয়ে জ্বাল দিন। প্রথমে আঁচ কমিয়ে, তার পরে আঁচ বাড়িয়ে দিন মিনিট দু’য়েক জ্বাল দিন। হালকা ঠান্ডা করে কাঁচের জারে রাখুন। ঠান্ডা হলে যদি দেখা যায় পাত্রের নিচের দিকে সাদা জমাট বেঁধে থাকে এবং উপর দিকে তেল উঠে থাকে, তা হলে বুঝতে হবে এটা ভেজাল। আর যদি জ্বাল দেওয়ার অনেকক্ষণ পরেও কিছু আলাদা না হয়ে সবটাই মিশে থাকে তা হলে তা খাঁটি ঘি।
• এক চামচ ঘিয়ের মধ্যে ৫ মিলি হাইড্রোক্লোরিক বা মিউরিয়াটিক অ্যাসিড যোগ করুন। যদি ঘি লাল হয় তবে বুঝবেন ঘিতে কোলটার ডাই মেশানো হয়েছে। বনস্পতি মেশানো থাকলেও এমনই ফল মিলবে।
• এক চামচ ঘিতে ৪-৫ ফোঁটা আয়োডিন যোগ করুন। যদি ঘিয়ের রং পরিবর্তিত হয়ে নীল হয়, তবে বোঝা যাবে ঘিতে সিদ্ধ আলু মেশানো হয়েছে।
বস্তুত রাজ্যে প্রথম বড়সড় বেজাল ঘিয়ের চক্র ধরা পড়ে শান্তিপুরের ফুলিয়ায়। কোনও ভুয়ো সংস্থার স্টিকার নয়, নামি-দামী বিভিন্ন সংস্থার ঘি এখান থেকে সরবরাহ হত। বেশ কয়েকটি ঘি তৈরির কারখানা ছিল ফুলিয়ায়।
গোপন সূত্রে খবর পেয়ে এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ সেখানে হানা দিয়ে টন টন ভেজাল ঘি বাজেয়াপ্ত করে।
বাজেয়াপ্ত করা হয় বনস্পতি, পাম তেল, রাসায়নিক। ঘি তৈরির মূল কাঁচা মাল ক্রিম। সেই কাঁচা মালের বেশিরভাগই আসে বিহার থেকে। যে কাঁচামাল পুলিশ বাজেয়াপ্ত করেছিল, তাও ছিল নিম্ন মানের। ওই ঘটনার পরে ভেজাল ঘি তৈরি বেশ কিছু দিন বন্ধ ছিল শান্তিপুরে। অভিযোগ সেখানে ফের ওই কারবার শুরু হয়েছে। ওই ভেজাল ঘি রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ছে।
তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পেরেছিল, বনগাঁ শহরের একটি দোকানে ওই ঘি পৌঁছে দেওয়ার কথা ছিল। সেখান থেকে ওই ঘি এলাকার বিভিন্ন দোকানে দোকানে সরবরাহ হওয়ার কথা ছিল। প্রবীণ মানুষেরা জানাচ্ছেন, তাঁদের ছোটবেলার ঘিয়ের স্বাদই ছিল আলাদা। দীর্ঘক্ষণ মুখে স্বাদ লেগে থাকত।
খাবারের দোকানেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভেজাল ঘি ব্যবহার হচ্ছে। একটি দোকানের মালিকের কথায়, ‘‘খাঁটি ঘি পাওয়া মুশকিল। তা ছাড়া, তার যা দাম, ব্যবসা করে পরতায় পোষায় না।’’ বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, ঘি হচ্ছে পরিশোধিত মাখন। দুধ জ্বাল দেওয়ার পরে তা ঘণ্টা তিনেক রেখে দিতে হয়। সর বসে গেলে দক্ষ কারিগর তা থেকে প্রথমে ক্রিম এবং পরে ঘি তৈরি করেন।
কিন্তু এখন বেশি লাভের জন্য কারবারিরা ঘিয়ের সঙ্গে বনস্পতি, রিফাইন তেল, বাটার ওয়েল, কেমিক্যাল, রং, সুগন্ধী মিশিয়ে দিচ্ছেন। খাঁটি দুধও তেমন মেলে না। ভেজাল দুধ দিয়েই তৈরি হয় ভেজাল ঘি। বেশির ভাগ মানুষ অবশ্য খাঁটি ও ভেজাল ঘিয়ের তফাত বোঝেন না। চিকিৎসকেরা জানাচ্ছেন, ভেজাল ঘি শরীরে অতিরিক্ত মেদ তৈরি করে। তা থেকে ফ্যাটি লিভার, কোলেস্টরাল, উচ্চ রক্তচাপ-সহ নানা রোগ হতে পারে।
হাবড়া স্টেট জেনারেল হাসপাতালের সুপার শঙ্করলাল ঘোষ বলেন, ‘‘ভেজাল ঘিয়ে কৃত্রিম রং, সুগন্ধী, রাসায়নিক মেশানো হয়। এর ফলে ওই ঘি নিয়মিত খেলে ক্যানসার, কিডনি, নার্ভের রোগ দেখা দিতে পারে। হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কাও থাকে।’’
ডিইবি অফিসার তপনকুমার বলেন, ‘‘ভেজাল ঘি তৈরি এবং বিক্রির বিরুদ্ধে আরও বেশি করে তল্লাশি চালানো হচ্ছে। মানুষ যদি আমাদের কাছে অভিযোগ করেন, তা হলে ধরপাকড় করা সহজ হয়।’’
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy