Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

স্বামীর অপেক্ষায় বুলবুলিদের থাকতে হয় টানা বারোটা বছর

স্বামী মাছ ধরতে গিয়েছিলেন গভীর সমুদ্রে। কিন্তু ট্রলার উল্টে নিখোঁজ হয় তিনি। আজও হাতে দুধ সাদা শাঁখা আর কপালে লাল বড় সিঁদুরেরে টিপ নিয়ে অপেক্ষা করেন নয়ন দাস। সমুদ্রে ইলিশ ধরতে গিয়ে তলিয়ে যাওয়া মানুষটি আর কোনও দিনও ফিরবে কিনা তা জানেন না নয়নদেবী। কিন্তু প্রচলিত রীতি মেনেই বারো বছর তাঁকে শাখা-সিঁদুর পড়েই থাকতে হবে। শুধু নয়নদেবী নন, গভীরসমুদ্রে ট্রলারে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া মৎস্যজীবীদের বধূদের এমন ভাবেই কাটাতে হয় দিনের পর দিন।

দিলীপ নস্কর
কাকদ্বীপ শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০১৪ ০০:৩২
Share: Save:

স্বামী মাছ ধরতে গিয়েছিলেন গভীর সমুদ্রে। কিন্তু ট্রলার উল্টে নিখোঁজ হয় তিনি। আজও হাতে দুধ সাদা শাঁখা আর কপালে লাল বড় সিঁদুরেরে টিপ নিয়ে অপেক্ষা করেন নয়ন দাস। সমুদ্রে ইলিশ ধরতে গিয়ে তলিয়ে যাওয়া মানুষটি আর কোনও দিনও ফিরবে কিনা তা জানেন না নয়নদেবী। কিন্তু প্রচলিত রীতি মেনেই বারো বছর তাঁকে শাখা-সিঁদুর পড়েই থাকতে হবে।

শুধু নয়নদেবী নন, গভীরসমুদ্রে ট্রলারে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হওয়া মৎস্যজীবীদের বধূদের এমন ভাবেই কাটাতে হয় দিনের পর দিন। সাধারণত সরকারি নিয়ম অনুযায়ী নিখোঁজ ব্যক্তির ক্ষেত্রে ৭ বছরের আগে ডেথ সার্টিফিকেট দেওয়া হয় না। তবে সামাজিক প্রচলিত রীতি মেনে আরও পাঁচ বছর এঁদের স্ত্রীদের সধবার সাজে থাকতে হয়। ১২ বছর কাটার পরেও যদি ঘরের মানুষ না ফেরেন, তবে সামাজিক রীতি মেনে খড় ও কাগজে তৈরি করা হবে নিখোঁজ স্বামীর কুশপুতুল। ওই কুশপুতুল খাটিয়ায় করে শ্মশানে নিয়ে গিয়ে দাহ করা হয়। দাহের পরে হিন্দুমতে সন্তান থাকলে গলায় নিতে হয় কাছা। তারপর শ্রাদ্ধের অন্য নিয়মাবলী পালন করা হয়। সম্প্রতি দক্ষিণ ২৪ পরগনার কাকদ্বীপ পঞ্চায়েত সমিতির তরফে আয়োজিত মৎস্যজীবীদের এমন কিছু পরিবারে চেক বিলি অনুষ্ঠান হল। চেক নিতে এসেছিলেন ৮ নম্বর কালীনগরের বাসিন্দা নয়ন দাস। তিনি জানান, স্বামী যোগেশ মাস খানেক আগে সমুদ্রে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। তাঁর বাড়িতে তিন মেয়ে। ছোট মেয়ের বয়স এখন মাত্র ছ’মাস। ওই পরিবারের সংসারের হাল ধরার মতো আর কেউ নেই। তাই বছর পঁচিশের বধূর উপরে দায়িত্ব এসে পড়েছে সংসার চালানোর। কিন্তু কী ভাবে সংসার চালাবেন নিজেও জানেন না নয়ন।

একই অবস্থা ওই এলাকার পশ্চিম গোপালপুরের বুলবলি দাসেরও। চার বছর আগে স্বামী গোপাল দাস এফবি শ্যামাচরণ ট্রলারে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে তলিয়ে যায়। তারপর থেকে সংসার চালানোর মতো অবস্থা ছিল না। দুই ছেলে সন্তোষ ও রতন নাবালক। বাবা নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার পরে পড়াশোনা ছেড়ে নেমে পড়ে অর্থের উপার্জনে। বুলবুলিদবীর হাতে এখনও শাঁখা, কপালে লাল সিঁদুরের টিপ। নিয়ম অনুযায়ী, এখনও বারো বছর হয়নি যে! যে সমুদ্র তাদের বাবাকে কেড়ে নিয়েছে, সেই সমুদ্রের মাছ মুখে রোচে না বলে জানায় সন্তোষরা। এদেরই প্রতিবেশী শেফালি দাস। বছর ষোলো আগে মাছ ধরতে গিয়ে এখনও ফেরেননি তাঁর স্বামী। ছোট ছোট ছেলেদের মুখে দু’বেলা অন্ন জোটাতে হিমসিম খেতে হয়েছে শেফালিদেবীকে। কিন্তু এখনও তিনি সধবার সাজেই আছেন। কারণ স্বমীর কুশপুতুল পুড়িয়ে শ্রাদ্ধ করার মতো ক্ষমতা তাঁর নেই বলে জানালেন। পরিচারিকার কাজ করে কোনও রকমে একবেলার খাওয়া জুটলেও আর এক বেলা অভুক্তই থাকতে হয় পরিবারটিকে। বর্তমানে এই পরিবারগুলিকে সরকারের পক্ষ থেকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কিন্তু এখনও পর্যন্ত এরা কেউই কোনও ক্ষতিপূরণ পায়নি বলে জানা গেল।

কাকদ্বীপে প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষই মৎস্যজীবী। মাছ ধরার মরসুম শুরু হয় জুন মাস থেকে। ট্রলারে করে গভীর সমুদ্রে মাছ ধরতে গিয়ে প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে প্রায়শই দুর্ঘটনা ঘটে। কপালের জোরে কেউ ফেরেন, কেউ ফেরেন না। আবার কারও দেহ উদ্ধার হয়, কারও হয় না। যাঁদের দেহ উদ্ধার হয়, তাঁদের পরিবার সরকারি জীবন বিমার অপমৃত্যুর ক্ষতিপূরণ হিসাবে প্রায় লক্ষাধিক টাকা পেয়ে যান। কিন্তু কপাল মন্দ যাঁদের, তাঁদের দেহ উদ্ধার হয় না। সে ক্ষেত্রে সরকারি ক্ষতিপূরণ পেতে লেগে যায় ৭ বছর। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, নিখোঁজের দিন থেকে সাত বছর পরে পঞ্চায়েত বা প্রশাসন থেকে ডেথ সার্টিফিকেট নিয়ে জেলা প্রশাসনের কাছে পাঠানোর পর সরকারি আর্থিক ক্ষতিপুরণ মেলে।

কাকদ্বীপ মৎস্যজীবী কল্যাণ সমিতির সম্পাদক বিজন মাইতি বলেন, “নিখোঁজ ওই পরিবারগুলির জন্য আমার বাড়ি প্রকল্পের মাধ্যমে বাড়ি করে দেওয়ার জন্য জেলা মৎস্য দফতরে জানিয়েছি।” আর্থিক সাহায্যের বিষয়ে স্থানীয় বিধায়ক তথা সুন্দরবন উন্নয়ন মন্ত্রী মন্টুরাম পাখিরা বলেন, “ওই পরিবারগুলির যে সময় দুর্ঘটনা ঘটেছিল, সে সময় সরকারি আর্থিক সাহায্যের পদ্ধতি চালু হয়নি। তবুও ওই পরিবারগুলিকে কোনও ভাবে সাহায্য করা যায় কিনা দেখব।”

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE