কর্মহীন দিন। —নিজস্ব চিত্র।
ফরওয়ার্ডিং এজেন্টদের আন্দোলনের জেরে বন্ধ হয়ে গেল পেট্রাপোল বন্দরের সীমান্ত বাণিজ্য।
বাণিজ্যের কাজে এদেশের বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যদের বাংলাদেশের বেনাপোল বন্দরে অবাধে যাতায়াতের উপরে শুল্ক দফতর ও বিএসএফ নিয়ন্ত্রণ আনার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তারই প্রতিবাদে আন্দোলনে নেমেছেন ফরওয়ার্ডিং এজেন্টরা। যার জেরে মঙ্গলবার সকাল থেকে আমদানি-রফতানির কাজ বন্ধ হয়ে যায়।
পেট্রাপোল শুল্ক দফতরের ডেপুটি কমিশনার শুভেন দাশগুপ্ত জানান, পেট্রাপোল ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট স্টাফ ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের লোকজন ট্রাক টার্মিনাসের গোডাউনের গেট বন্ধ করে দেন। ফলে পণ্য-ভর্তি ট্রাক বের হতে পারেনি। কিছু ট্রাকচালক বেনাপোলে যাওয়ার চেষ্টা করলে তাঁদেরও আটকে দেওয়া হয়েছে। বাণিজ্যের কাজ শুরু করতে পুলিশের সাহায্য চাওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি। যদিও ফরওয়ার্ডিং এজেন্টদের বক্তব্য, তাঁরা আন্দোলন করছেন ঠিকই। কিন্তু তার জেরে বাণিজ্য বন্ধ হয়নি। তাঁদের দাবি, বেনাপোলে গিয়ে বাংলাদেশ শুল্ক দফতর থেকে গাড়ির পাস নিয়ে আসার কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সে জন্যই বাণিজ্য বন্ধ।
এ দিন সকালে পেট্রাপোল বন্দরে গিয়ে দেখা গেল, ট্রাক টার্মিনাসের গোডাউনের গেটে সংগঠনের পতাকা লাগিয়ে বিক্ষোভ দেখাচ্ছেন এজেন্টরা। সংগঠনের সভাপতি খোকন পাল বলেন, ‘‘১৯৭৩ সাল থেকে আমাদের সংগঠনের সদস্যেরা বেনাপোলে গিয়ে বাংলাদেশ শুল্ক দফতর থেকে গাড়ির পাস এনে ট্রাক চালকদের দেন। তবেই চালকেরা পণ্য নিয়ে বেনাপোলে ঢোকেন। আবার বিকেলে পণ্য খালাস হয়ে গেলে আমরা ও দেশের শুল্ক দফতর থেকে ‘সাইনইন ভয়েস’ নিয়ে আসার কাজ করি।” তাঁর বক্তব্য, “বৃহস্পতিবার থেকে শুল্ক দফতর আমাদের ঢোকা বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে এ দেশের ট্রাকচালক ও খালাসিরা বেনাপোলে আতঙ্কের মধ্যে রয়েছেন।” শুল্ক দফতরের আধিকারিকেরাই পরোক্ষে বাণিজ্যের কাজ বন্ধ করে দিয়েছেন বলে তাঁর অভিযোগ।
কিন্তু কেন এই সমস্যা? শুল্ক দফতর সূত্রের খবর, সাম্প্রতিক সময়ে দেশের বৃহতম স্থলবন্দর পেট্রাপোল দিয়ে সোনা পাচারের ঘটনার বেশ কিছু প্রমাণ মিলেছে। সোনার বাট ও বিস্কুট-সহ কয়েক জন পাচারকারীকে বিএসএফ এবং শুল্ক দফতর হাতেনাতে পাকড়াও করেছে। তাদের জেরা করে জানা গিয়েছে, দুবাই থেকে সোনার বিস্কুট নিয়ে ঢাকা হয়ে বেনাপোল সীমান্ত পেরিয়ে ওই সকলে এ দেশে ঢুকেছে। জানা যাচ্ছে, সোনার বিস্কুট-সহ ধরা পড়া পাচারকারীদের মধ্যে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত কয়েক জনও ছিলেন। বাংলাদেশের ক্লিয়ারিং এজেন্ট ও এ দেশের ফরওয়াডিং এজেন্টও গ্রেফতার হয়েছিলেন। যা আরও বেশি উদ্বেগের কারণ বলে মনে করছেন বিএসএফ ও শুল্ক দফতরের আধিকারিকেরা। কারণ, এই সব ব্যক্তি বাণিজ্যের কারণ দেখিয়ে দু’দেশের মধ্যে অবাধে যাতায়াত করেন। অনেকেরই সরকারি বা সরকার অনুমোদিত বৈধ পরিচয়পত্র নেই।
ওই ঘটনা সামনে আসতেই নড়ে চড়ে বসেন বিএসএফ এবং শুল্ক দফতরের কর্তারা। এরপরেই বাণিজ্যিক কারণে দু’দেশের মধ্যে এজেন্টদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করতে উদ্যোগী হয় বিএসএফ ও শুল্ক দফতর। কী ভাবে পেট্রাপোলের নিরাপত্তা বাড়িয়ে এজেন্টদের যাতায়াত নিয়ন্ত্রণ করা যায়, তা নিয়ে গত ২৩ মে স্থানীয় হরিদাসপুরে বিএসএফ ক্যাম্পে শুল্ক দফতরের অপরাধ দমন শাখার কমিশনার ও বিএসএফের ডিআইজি যৌথ বৈঠক করেন।
শুল্ক দফতর সূত্রে জানানো হয়েছে, ওই বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়, এখন থেকে শুল্ক দফতরের অনুমোদন ছাড়া কেউ বাংলাদেশে বাণিজ্যের কাজে অবাধে যাতায়াত করতে পারবেন না। শুল্ক দফতরের সহকারী কমিশনার একটি নোটিস দিয়ে বৈঠক ডাকেন। সেখানে বলা হয়, যে সব সংগঠনের প্রতিনিধিরা বেনাপোলে বাণিজ্যের জন্য যাতায়াত করেন, তাঁদের নামের তালিকা জমা দিতে হবে। শুভেনবাবু বলেন, ‘‘ক্লিয়ারিং এজেন্টদের সংগঠনের সদস্যেরা আমাদের অনুমোদন নিয়ে যাতায়াত করেন। ফরওয়ার্ডিং এজেন্টরা তাঁদের নিজেদের সংগঠনের সম্পাদক বা সভাপতির স্বাক্ষর যুক্ত কার্ড নিয়ে যাতায়াত করেন। কিন্তু এখন থেকে আমাদের অনুমোদন ছাড়া সীমান্তের ও পারে কেউ যেতে পারবেন না।” তাঁর বক্তব্য, নিদিষ্ট সংখ্যক লোককেই যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হবে। কারণ, শুল্ক দফতর খতিয়ে দেখেছে, সব সংগঠনের সকলের বেনাপোলে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ৫০ জন ক্লিয়ারিং এজেন্টকে ও পারে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলেও জানিয়েছেন তিনি। শুল্ক দফতর জানায়, ফরওয়ার্ডিং এজেন্টদের সংগঠনের সদস্য প্রায় তিনশো। যাঁদের মধ্যে অনেকেই এই কাজের সঙ্গে যুক্ত নন এমন ব্যক্তিরও কার্ড রয়েছে। সকলকে অবাধে সীমান্তের ও পারে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া যায় না। কিন্তু সেই দাবিই উঠেছে।
শুল্ক দফতরের আধিকারিকেরা জানিয়েছেন, ১২০ জনের নামের তালিকা পাঠানো হয়েছে। ৩০ জনকে ছাড়পত্র দিতে চাওয়া হয়েছিল। তাতে এজেন্টরা রাজি নন। নতুন নিয়মে, সীমান্তের মূল গেটের কাছে একটি চেকপোস্ট করা হয়েছে। যেখানে বিএসএফ এবং শুল্ক দফতরের একজন করে অফিসার থাকবেন। তাঁরা উভয় দেশের মধ্যে যে এজেন্টরা যাতায়াত করবেন, তাঁদের গতিবিধি সম্পর্কে নথি লিপিবদ্ধ করবেন। এই সব নিয়ম-কানুন অবশ্য পরীক্ষামূলক ভাবে চালু করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন শুভেনবাবু।
আন্দোলনকারীদের দাবি, ২০০৫ সালে কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রক তাঁদের যাতায়াতের উপরে শিলমোহর দেয়। তারপর থেকেই এই ব্যবস্থা চলে আসছে। খোকনবাবু বলেন, ‘‘বেআইনি ভাবে আমরা বাংলাদেশে ঢুকতে চাই না। আমাদের দাবি, নো-ম্যানস ল্যান্ডে গাড়ির পাস নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এ দেশের চালক-খালাসিদের ও দেশে নিরাপত্তার দায়িত্বও নিতে হবে। পাশাপাশি, এ দেশের ট্রাক টার্মিনাস থেকেই মালপত্র চেকিং করুক শুল্ক দফতর। কারণ এ দেশের ট্রাক থেকে মালপত্র চুরি-ছিনতাই হচ্ছে বেনাপোলে। যার দায়িত্ব পড়ছে চালক-খালাসিদের উপরে।
তাঁর দাবি, তাঁদের সংগঠনের কোনও সদস্য সোনার বিস্কুট নিয়ে ধরা পড়েননি। তাঁরাও চান, দেশের স্বার্থে সীমান্তে নিরাপত্তা বাড়ানো হোক। কিন্তু দাবি মানা না হলে আন্দোলন চলবে বলে তিনি জানিয়েছেন। শুল্ক দফতর অবশ্য জানিয়েছে, সমস্যা নিয়ে আলোচনা করা যেতে পারে, কিন্তু তা বাণিজ্য বন্ধ করে নয়।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy