Advertisement
০৫ নভেম্বর ২০২৪

চিকিৎসার খরচ ১০ লক্ষ টাকা, সরকারের ১০০ কোটির তহবিলেও নেই সাহায্য!

মালদহের ইংলিশবাজারের বাসিন্দা ঋদ্ধিমা জিনের বিরল রোগ স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফিতে (এসএমএ) আক্রান্ত। এই রোগে শরীরের বিভিন্ন পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

দৃঢ়চেতা: পড়াশোনায় মগ্ন ঋদ্ধিমা পাল। —নিজস্ব চিত্র

দৃঢ়চেতা: পড়াশোনায় মগ্ন ঋদ্ধিমা পাল। —নিজস্ব চিত্র

সোমা মুখোপাধ্যায়
কলকাতা শেষ আপডেট: ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৮ ০৩:৩৫
Share: Save:

টানা আধ ঘণ্টাও সোজা হয়ে বসে থাকতে পারে না। ব্যথায় কুঁকড়ে যায় ছোট্ট শরীরটা। মেরুদণ্ডের অবস্থা এমনই যে ক্রমশ তা নুয়ে পড়ে চাপ দিচ্ছে ফুসফুসকে। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, এ ভাবে চলতে থাকলে ফুসফুস অচিরেই স্বাভাবিক কাজের ক্ষমতা হারাবে। তখন ভেন্টিলেশনে দিতে হবে ১৩ বছরের ঋদ্ধিমা পালকে।

মালদহের ইংলিশবাজারের বাসিন্দা ঋদ্ধিমা জিনের বিরল রোগ স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফিতে (এসএমএ) আক্রান্ত। এই রোগে শরীরের বিভিন্ন পেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। হাত-পা, পাচনতন্ত্র, শ্বাসযন্ত্র, হৃদ্‌যন্ত্র সবই ধীরে ধীরে অচল হতে শুরু করে। কখনও আবার তাদের মেরুদণ্ড নুয়ে পড়তে থাকে, চিকিৎসার পরিভাষায় যাকে বলে স্কোলিওসিস। এই মুহূর্তে ঋদ্ধিমারও সেটাই হয়েছে।

এই বিপদ থেকে আপাতত উদ্ধার পেতে হলে দ্রুত অস্ত্রোপচার দরকার, যার খরচ অন্তত লাখ দশেক টাকা। ঋদ্ধিমার বাবা-মা জানিয়েছেন, এই মুহূর্তে টাকাটা জোগাড় করা তাঁদের পক্ষে অসম্ভব। কারণ, এখনই মেয়ের চিকিৎসার জন্য মাসে প্রায় ৪০ হাজার টাকা খরচ হয়। বাজারে বিস্তর দেনা। প্রশ্ন উঠেছে, সরকারি তরফে ঋদ্ধিমার মতো বিরল রোগে আক্রান্তদের জন্য সাহায্যের কি কোনও ব্যবস্থাই নেই?

২০১৭ সালে বিরল রোগের চিকিৎসায় সরকারি তহবিল গড়ার বিষয়ে জাতীয় নীতি তৈরি হয়েছিল। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রক তো বটেই, স্থির হয়েছিল বিভিন্ন রাজ্যেও এই তহবিল থাকবে। প্রাথমিক ভাবে ১০০ কোটি টাকার তহবিলও গঠিত হয়। স্থির হয়, ৬০-৪০ অনুপাতে কেন্দ্র ও রাজ্যের তরফে খরচ হবে। রাজ্য ‘টেকনিক্যাল কমিটি’ গড়লে তার মাধ্যমে টাকার জন্য কেন্দ্রের কাছে আবেদন করতে পারবেন বিরল রোগে আক্রান্ত বা তাঁদের পরিবারের লোকেরা।

কিন্তু স্বাস্থ্য মন্ত্রক সূত্রে খবর, এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র ঝাড়খণ্ড, মহারাষ্ট্র, কর্নাটক এবং দিল্লি এই কমিটি তৈরি করেছে। কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্য মন্ত্রকের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘এ পর্যন্ত ৮৩টি শিশুর পরিবার এই সাহায্যের জন্য আবেদন করেছে। অথচ সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলিতে এখনও ওই কমিটি তৈরি হয়নি। ফলে টাকা থাকা সত্ত্বেও ওই শিশুদের সাহায্য করতে পারছি না।’’

এ রাজ্যের স্বাস্থ্য-শিক্ষা অধিকর্তা প্রদীপ মিত্র জানান, এখানে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। কোনটা বিরল রোগ আর কোনটা নয়, তা পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটিও রয়েছে। তা হলে ঋদ্ধিমার মতো রোগীরা কেন সেই তহবিল থেকে সাহায্য পাচ্ছে না? দফতরের এক শীর্ষ কর্তা বলেন, ‘‘কোন রোগের চিকিৎসায় সাহায্য করলে রোগ সারার সম্ভাবনা রয়েছে, সেটা অন্যতম বিচার্য। স্পাইনাল মাস্কুলার অ্যাট্রফির ক্ষেত্রে এত দিন কোনও ওষুধ ছিল না। সম্প্রতি একটি ওষুধ এসেছে ঠিকই, তবে তার খরচ বছরে সাত কোটি টাকা। আর তার সাফল্যের হার নিয়েও এখনও নিঃসংশয় হওয়া যায়নি। ফলে এখনও পর্যন্ত এ ক্ষেত্রে আর্থিক সাহায্য না-করার সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়েছে।’’ আক্রান্তদের সাময়িক ভাবে স্বাভাবিক রাখার জন্য কোনও আর্থিক সাহায্য? না! আপাতত সেটাও নয়।

এ রাজ্যে কয়েক জন এসএমএ আক্রান্ত শিশুর বাবা-মা নিজেদের একটি গোষ্ঠী তৈরি করেছেন। এখনও পর্যন্ত ১০০ জন শিশুর হদিস রয়েছে সেই গ্রুপে। ওই অভিভাবকেরা একজোট হয়ে কেন্দ্র ও রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তাদের কাছে আবেদন জানিয়েছেন, ‘যে করেই হোক আমাদের সন্তানকে বাঁচান।’

সংগঠনের তরফে মৌমিতা ঘোষ বলেন, ‘‘আমার মেয়ে দেবস্মিতার বয়স এখন আট বছর। কিছুদিন আগেও ওর মেরুদণ্ড ২৫ শতাংশ নুয়ে ছিল। এখন ৭০ শতাংশ নুয়ে গিয়েছে। চিকিৎসা করালে রোগটা পুরোপুরি হয়তো সারবে না। কিন্তু নতুন করে ক্ষতি হওয়া আটকানো যাবে। আশা করি, রাজ্যের স্বাস্থ্যকর্তারা বিষয়টা বুঝবেন।’’ এ ক্ষেত্রে সামনে রয়েছে অন্ধ্রপ্রদেশের বাসিন্দা এসএমএ আক্রান্ত কিশোরী এস শ্রেয়ার উদাহরণ। কেন্দ্রীয় তহবিলের টাকা না পেলেও সেখানকার সরকারের কাছ থেকে অস্ত্রোপচার বাবদ ১২ লক্ষ টাকা পেয়েছে শ্রেয়া। আপাতত মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের দিকে তাকিয়ে রয়েছে এ রাজ্যের এসএমএ আক্রান্তদের পরিবার।

এই শিশুদের চিকিৎসার নানা ধরনের চাহিদা থাকে। সাধারণ শিশু চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে থাকার পাশাপাশি আক্রান্তের ফুসফুসের অবস্থা নিয়মিত নজরে রাখার জন্য রেসপিরেটরি মেডিসিন, মেরুদণ্ড এবং হাড়ের জন্য অর্থোপেডিক, পুষ্টির পরিমাণ ঠিকঠাক রাখার জন্য ডায়েটিশিয়ান এবং তাদের শারীরিক সক্ষমতা বজায় রাখার জন্য ফিজিওথেরাপি—সব কিছুরই নিয়মিত দরকার পড়ে। যেমনটা পড়ছে ঋদ্ধিমার ক্ষেত্রে। মালদহ গার্লস হাই স্কুলের এই ছাত্রীকে হুইল চেয়ারে স্কুলে নিয়ে যাওয়া হয়। তবে কোনও দিনই পুরো সময় স্কুলে থাকতে পারে না সে। দু’তিনটি পিরিয়ডের পরেই বাড়ি ফিরে আসতে হয়। পরীক্ষায় তার জন্য কিছুটা বাড়তি সময়ের ব্যবস্থা রাখে স্কুল। কোনও মতে লেখা শেষ করার চেষ্টা চালায় সে।

এরই মধ্যে ঋদ্ধিমা আবৃত্তি করে। ছবি আঁকে। দাবা খেলে। মা অরুণিতা বললেন, ‘‘এত যন্ত্রণা সহ্য করেও মেয়েটা স্বপ্ন দেখতে ভোলেনি। ভবিষ্যতে অনেক কিছু করার কথা বলে। জীবন ওকে সেই সুযোগ দেবে কি না, জানি না। তবে ওকে দেখে প্রতিদিন লড়াই করার জোরটা পাই।’’

সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement

Share this article

CLOSE