অপর্ণা বাগের নিথর দেহের সামনে আত্মীয়ার কান্না। রবিবার কৃষ্ণগঞ্জ হাসপাতালে। ছবি: সুদীপ ভট্টাচার্য
দিনমজুরির কাজে অধিকাংশ পুরুষ গ্রামের বাইরে। চাষাবাদের কাজ করছিলেন মহিলারা। নদিয়ার কৃষ্ণগঞ্জ ব্লকে সিপিএম প্রভাবিত ঘুঘড়াগাছি গ্রামে রবিবারের সকালটা ছিল আর পাঁচটা দিনেরই মতো। আচমকা শান্ত গ্রাম অশান্ত হয়ে উঠল দুষ্কৃতীদের হানায়। জমি দখলের জন্য খেতের ফসল নষ্ট করেই এগিয়ে আসছে তিনটি ট্রাক্টর। তাতে অন্তত ৪০-৫০ জন দুষ্কৃতী। প্রথমে কিছুটা দমে গেলেও এ ভাবে ফসল নষ্ট করতে দেখে রুখে দাঁড়ান মহিলারাই। দুষ্কৃতীরা প্রথমে বোমা ছোড়ে। তার পরে এলোপাথাড়ি গুলি। খেতে জল দিচ্ছিলেন বছর আটত্রিশের অপর্ণা বাগ। বুকে গুলি লেগে মাঠেই ঢলে পড়েন তিনি। আহত হন আরও তিন জন। ক্ষুব্ধ গ্রামবাসীরা পরে পুলিশের একটি গাড়ি ভাঙচুর করেন।
ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত লঙ্কেশ্বর ঘোষ ওরফে লঙ্কা তৃণমূল ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত। পুলিশ লঙ্কাকে ধরতে পারেনি। তিনি ‘পলাতক’ বলে পুলিশের দাবি। লঙ্কা নিজেকে ‘আগাগোড়া তৃণমূল’ বলে দাবি করেছেন। হামলায় জড়িত থাকার কথা অস্বীকার করে বলেন, এ দিন সকাল থেকে তিনি বাড়িতেই ছিলেন। বিজেপি ও সিপিএমের অভিযোগ, আসন্ন কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভা উপ-নির্বাচনের আগে ওই এলাকায় সন্ত্রাস ছড়াতেই দুষ্কৃতীদের দিয়ে জমি জবরদখলে মদত দিচ্ছে তৃণমূল। এ দিনই কলকাতায় সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক বিমান বসু প্রেস বিবৃতিতে ‘তৃণমূলের বর্বরোচিত আক্রমণের তীব্র নিন্দা’ করে গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার ডাক দেন। তৃণমূল নেতৃত্ব অবশ্য লঙ্কাকে ‘সমাজবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে ঘটনার সঙ্গে দলের কারও যোগ থাকার দায় নিতে অস্বীকার করছেন।
গুলিবিদ্ধ অপর্ণা বাগের মৃত্যু হয় মাঠেই। গুলিতে জখম হন লতিকা তরফদার এবং শ্যামলী তরফদার নামে আরও দুই গ্রামবাসী এবং রাজীব মণ্ডল নামে স্থানীয় স্বর্ণখালি হাইস্কুলের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রও। বাকিদের চিকিৎসা স্থানীয় ভাবে চললেও শ্যামলীদেবীকে কলকাতার হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
নিহত অপর্ণাদেবীর পরিবারের পক্ষ থেকে এ দিন দুপুরেই লঙ্কা-সহ সাত জনের বিরুদ্ধে থানায় নির্দিষ্ট অভিযোগ দায়ের করা হয়। পুলিশ সুপার অর্ণব ঘোষ ঘটনাস্থলে গিয়ে গ্রামবাসীদের আশ্বাস দেন, “জমির দখল নিতে সমাজবিরোধীদের হামলার অভিযোগটি অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে। কাউকে ছাড়া হবে না।” লঙ্কাকে কেন গ্রেফতার করা হল না, পরে এই প্রশ্নের উত্তরে অবশ্য পুলিশ সুপার কোনও মন্তব্য করতে চাননি। বারবার ফোন কেটে দিয়েছেন। পরে তিনি এসএমএসে জানান, ‘কেউ ধরা পড়েনি।’
হঠাৎ কেন এই হামলা?
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, কৃষ্ণগঞ্জ বিধানসভা এলাকায় তৃণমূল শক্তিশালী হলেও ৭টি পঞ্চায়েতের মধ্যে জঘাটা ও গোবিন্দপুর এখনও সিপিএমের দখলে রয়েছে। ঘুঘড়াগাছি গ্রামটি জঘাটা পঞ্চায়েতের অন্তর্গত। সেখানে ২২ বিঘার মতো জমির মালিকানা নিয়ে জট রয়েছে। বছর তিরিশেক আগে বাম জমানায় গ্রামেরই ৫৬টি গরিব পরিবারের মধ্যে ওই জমি ভাগ করে দেওয়া হয়। সেখানে ডালশস্য এবং শাকসব্জি চাষ করে সংসার চালাত পরিবারগুলি।
হামলায় আক্রান্তদের অভিযোগ, সম্প্রতি স্থানীয় পিরপুর এলাকার নেপাল ঘোষ, পলাশ ঘোষ ও নাথপুর পাড়ার বাসিন্দা লঙ্কা ঘোষ দাবি করেন, কলকাতায় আসল মালিকের কাছ থেকে ওই জমি তাঁরা কিনে নিয়েছেন। জমির দখল পাওয়ার জন্য মাস তিন-চারেক ধরে তাঁরা হুমকিও দিচ্ছিলেন। এ নিয়ে কৃষ্ণগঞ্জ থানায় অভিযোগও জানান গ্রামবাসীরা। তবে, চাষাবাদ বন্ধ রাখেননি। তার জন্যই এই হামলা হল।
এ দিন দুষ্কৃতীদের আসতে দেখে প্রথমে মহিলারা পিছিয়ে গেলেও পরে গ্রামের আরও অনেককে সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। তখনই সমাজবিরোধীদের দলটি এলোপাথাড়ি গুলি ছুড়তে থাকে। প্রাণহানির পরে দুষ্কৃতীরা পালায়। ঘটনাস্থলে পুলিশ আসে। দেরি হল কেন জানতে চেয়ে গ্রামবাসী পুলিশের সঙ্গে বচসায় জড়ান। পুলিশের একটি গাড়িতে ভাঙচুর চালানো হয়। পরে হাঁসখালি থানা থেকে বড় পুলিশবাহিনী এসে পরিস্থিতি আয়ত্তে আনে।
সিপিএম সমর্থক ওই গ্রামবাসীদের অভিযোগ, পুলিশ ও শাসক দলের মদতেই লঙ্কা তাঁর গরু পাচারকারীদের দলবল নিয়ে এ দিন হামলা চালায়। ওই গ্রামের বছর ষাটেকের গীতা বিশ্বাস বললেন, “হামলার খবর পেয়ে যখন মাঠে যাই তখন জোর গোলাগুলি চলছে। অপর্ণা পড়ে আছে দেখে আমি ছুটে যাই। ওর মাথা তুলে ধরি। আমার কোলেই ওর মৃত্যু হয়।” আর এক প্রৌঢ়া শিখা সর্দারের অভিযোগ, “দুষ্কৃতী দলটি নিহত ও আহতদের তুলে অন্যত্র নিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। আশপাশের এলাকা থেকে লোকজন জড়ো হতে শুরু করলে ওরা পিঠটান দেয়।” গোপেশ্বর বর্মন নামে এক গ্রামবাসীর অভিযোগ, “পুলিশ আমাদের কথা শুনছিল না। উল্টে তেড়ে আসে আমাদের দিকে। এমনকী, বন্দুকও তাক করে।”
সদ্য প্রয়াত হয়েছেন কৃষ্ণগঞ্জের তৃণমূল বিধায়ক সুশীল বিশ্বাস। উপ-নির্বাচনে জেতার জন্য মরিয়া হয়ে তৃণমূল পরিকল্পিত ভাবে এ দিন দলীয় সমর্থকদের উপরে হামলা চালালবলে অভিযোগ সিপিএমের। সিপিএম নেতারা মনে করেন, এ দিন সাড়ে তিন কিলোমিটার দূরে কৃষ্ণগঞ্জে দলের লোকাল কমিটির সম্মেলন ছিল। গ্রামের নেতারা অনেকেই সেখানে চলে যাওয়ায় সেই সুযোগ কাজে লাগায় দুষ্কৃতীরা।
সিপিএমের জেলা সম্পাদক সুমিত দে বলেন, “তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা আর্থিক কারণে ওই জমি জবরদখল করতে গিয়েছিল। গ্রামে বন্দুক দেখিয়ে সন্ত্রাসের আবহ তৈরি করতে চাইছিল। বিজেপির জেলা মুখপাত্র সৈকত সরকার এক ধাপ এগিয়ে বলেন, “তৃণমূল-আশ্রিত কিছু দুষ্কৃতী জমির দখল নিতে চাইছে। তারা সকলেই ব্লক তৃণমূল সভাপতি লক্ষ্মণ ঘোষ চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ।”
লক্ষ্মণবাবু অবশ্য দাবি করেছেন, “সমাজবিরোধী লঙ্কার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই। ওই গ্রামবাসীরা মাসখানেক আগে আমার কাছে সাহায্য চাইতে এসেছিলেন। আমি ওঁদের জন্য ব্লক ভূমি দফতরেও গিয়েছিলাম। জানতে পারি ওই জমির পাট্টা নেই কারও কাছে। তখনই বিষয়টি থেকে বেরিয়ে আসি।” জেলা তৃণমূল সভাপতি গৌরীশঙ্কর দত্তের দাবি, “হার্মাদবাহিনী এবং দাঙ্গাবাজরা অপপ্রচার করছে। উপনির্বাচনে এর উত্তর পেয়ে যাবে ওরা।”
দিনের শেষে লঙ্কা অবশ্য জানিয়েছেন, বছর দুই আগে তিনি ওই জমি কিনবেন বলে স্থির করেছিলেন। কিন্তু কেনেননি। কেন? লঙ্কার উত্তর, “গোলমাল আছে বুঝতে পেরে আমি আর জমি কিনিনি। ওই জমির সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্ক নেই।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy