মালিকের নাম সুদীপ্ত সেন। কোম্পানি খোলার ক্ষেত্রে তাঁর যা ব্যাটিং গড়, তাতে ঈর্ষায় জ্বলতেই পারেন তাবড় ব্যাটসমানরা! কারণ মাত্র এগারো দিনে সুদীপ্ত খুলেছিলেন ৯৩টি সংস্থা! অর্থাৎ গড়ে দিনে ৮টি-রও বেশি! এবং সব ক’টি সংস্থাই সারদা-সাম্রাজ্যের অংশ। অর্থাৎ, সব-ই সারদা গ্রুপ অফ কোম্পানিজ-এর অন্তর্গত।
সারদা-সংস্থার বিস্তার নিয়ে এমন তথ্য হাতে আসার পরে রীতিমতো চমকে গিয়েছেন এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)-এর গোয়েন্দারা। দু’সপ্তাহেরও কম সময়ের মধ্যে তড়িঘড়ি কেন প্রায় একশোটি সংস্থা খুলেছিলেন সুদীপ্ত, সেটাই এখন খুঁজে বের করতে চান তদন্তকারীরা। বিশেষ করে, ওই সংস্থাগুলি খোলা হয় ২০১১-র জানুয়ারিতে। এর চার মাস পরে, মে মাসে রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদল হয়। ৩৪ বছরের বামফ্রন্ট জমানার অবসান ঘটিয়ে রাজ্যে ক্ষমতায় আসে হয় মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার।
তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর থেকেই সারদা গোষ্ঠীর ব্যবসা যে ফুলেফেঁপে ওঠে ও আমানত সংগ্রহের পরিমাণ কয়েক গুণ বৃদ্ধি পায়, সেই তথ্য বিভিন্ন সংস্থার তদন্তে বার বার উঠে এসেছে। কিন্তু তৃণমূল ক্ষমতায় আসার মাত্র চার মাস আগে কেন এক সঙ্গে প্রায় শ’খানেক কোম্পানি খুলতে হল সুদীপ্তবাবুকে, তার উত্তর মিললে সারদা-রহস্যের জট কিছুটা হলেও খুলবে বলে তদন্তকারীদের একাংশ মনে করছেন। ইডি-র অনুসন্ধানে ইতিমধ্যেই ধরা পড়েছে, আমানত তোলার পরিমাণ বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নিত্যনতুন কোম্পানি খুলে ওই টাকা সেখানে চালান (সাইফন) করে দিতেন সুদীপ্ত।
২০১১-র জানুয়ারিতে যখন জেট গতিতে একটার পর একটা নতুন কোম্পানি তৈরি করছেন সুদীপ্ত, তখন পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল বিরোধী দল হলেও রাজ্য জুড়ে পরিবর্তনের হাওয়া প্রবল। তৃণমূল তখন কেন্দ্রে ইউপিএ-২-র অন্যতম শরিক। মমতা নিজে রেলমন্ত্রী। বস্তুত, ২০০৯-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলের মধ্যেই সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল যে, দু’বছর পর তৃণমূল-কংগ্রেস জোট রাজ্যের ক্ষমতায় আসতে চলেছে।
ইডি জেনেছে, সারদার ওই ৯৩টি সংস্থা খোলা হয়েছিল ২০১১-র ১২ জানুয়ারি থেকে ২৪ জানুয়ারির মধ্যে। ওই ১৩ দিনের মধ্যে ১৬ তারিখ ছিল রবিবার, ২৩ তারিখ ছিল সুভাষচন্দ্র বসুর জন্মদিন। স্বভাবতই ওই দু’দিন কোনও কোম্পানি খোলা সম্ভব ছিল না। বাকি এগারো দিনেই খোলা হয়েছিল সংস্থাগুলি। ইডি-র হাতে আসা কেন্দ্রীয় কর্পোরেট বিষয়ক মন্ত্রকের নথি বলছে, এর মধ্যে ১৪ জানুয়ারি এক দিনেই সর্বাধিক ২৩টি কোম্পানি খোলা হয়েছিল। ২৪ জানুয়ারি খোলা হয়েছিল ১৬টি কোম্পানি। এর মধ্যে ছিল জমি, আবাসন, পরিকাঠামো, টাউনশিপ, বিনোদন, শপিং মল, চর্মশিল্প নগরী, পর্যটন, ক্রীড়া অ্যাকাডেমি, তথ্যপ্রযুক্তির মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রের কোম্পানি। তবে সংখ্যার নিরিখে এগিয়ে ছিল আবাসন, জমি, পরিকাঠামো সংক্রান্ত সংস্থাগুলি।
তদন্তকারীরা জেনেছেন, ২০০৯ সালে সারদার মোট কোম্পানির সংখ্যা ছিল ১৩টি। তিন বছর বাদে সেটাই বেড়ে হয় ২৩৯! কোম্পানির সংখ্যা বৃদ্ধির গতি সব চেয়ে বেশি ছিল ২০১১-তে। ইডি-র বক্তব্য অনুযায়ী, সে বছর সারদার মোট ১২৮টি কোম্পানি খোলা হয়েছিল। তার মধ্যে ৯৩টি জানুয়ারির ওই এগারো দিনে। তদন্তকারীদের একাংশের ধারণা, এক সঙ্গে প্রচুর টাকা আমানত হিসেবে হাতে চলে আসায় নিত্যনতুন নামে একাধিক কোম্পানি খোলেন সুদীপ্তবাবু। তিনি বুঝেছিলেন, অদূর ভবিষ্যতে আরও আমানত আসবে।
তদন্তকারীদের যুক্তি, ২০১১-র জানুয়ারির আগের মাসে, অর্থাৎ ২০১০-এর ডিসেম্বরে সারদার ২৮টি কোম্পানি খোলা হয়েছিল। আবার জানুয়ারি মাসে ৯৩টি কোম্পানি খোলার পর গোটা ফেব্রুয়ারি মাসে সুদীপ্ত মাত্র ১১টি কোম্পানি খোলেন। ইডি আরও জেনেছে, ২০১০-এর ডিসেম্বরে একটি চালু বাংলা দৈনিক কিনতে উদ্যোগী হন সুদীপ্ত। এমনকী, সারদা গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত হওয়ার আগেই ওই দৈনিককে ঢেলে সাজতে প্রাথমিক ভাবে কয়েক কোটি টাকা লগ্নিও করেন। অথচ ২০১০-এর জুনে সারদা গোষ্ঠীর নিজস্ব একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি দৈনিক প্রকাশিত হয়েছিল। ইডি-র বক্তব্য, তার ছ’মাসের মধ্যে নতুন দৈনিক সংবাদপত্র কিনতে উদ্যোগী হওয়ার অর্থ, ২০১০-এর নভেম্বরের মধ্যে সারদা মোটা অঙ্কের টাকা আমানত হিসেবে পেয়েছিল এবং আরও মোটা অঙ্কের টাকা আমানত হিসেবে ভবিষ্যতে পাওয়ার ব্যবস্থা করে ফেলেছিল।
কী ভাবে এটা সম্ভব হল, সেটাই এখন খতিয়ে দেখছে ইডি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy