বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনের মঞ্চে সামনের সারিতে পরিবহণ সচিব আলাপন বন্দ্যোপাধ্যায়। পাশে দুই মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম ও অমিত মিত্র। পিছনের সারিতে ব্রাত্য বসু ও সুব্রত মুখোপাধ্যায়। রয়েছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। বৃহস্পতিবার যুবভারতীতে। ছবি: দেবাশিস রায়।
বুধবার ছিল ৯৩ হাজার কোটি টাকা। রাত পোহাতেই ‘মমতা ম্যাজিক’-এ তা হয়ে গেল ২ লক্ষ ৪৩ হাজার কোটি!
সল্টলেক স্টেডিয়ামে তিন দিনের বিশ্ববঙ্গ সম্মেলনের শেষে রাজ্যে বিনিয়োগ নিয়ে এমন ঘোষণায় অনেক প্রতিনিধি মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেও মুখ্যমন্ত্রী ভ্রূক্ষেপহীন। উল্টে নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ে বললেন, “ফ্যাবুলাস, ফাটাফাটি...!”
গত সাড়ে তিন বছরে কোটি কোটি টাকা খরচ করে কলকাতা ও হলদিয়া মিলিয়ে তিন বার শিল্প সম্মেলন করেছে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকার। বিনিয়োগ টানতে মুম্বই ও সিঙ্গাপুরে হয়েছে রোড শো। কোনও বারই ব্যাটে-বলে হয়নি। নবান্নের কর্তারাই বলছেন, অনেক চেষ্টা করে স্কোরবোর্ডে এক-দু’রান এসেছে বটে, কিন্তু চার-ছয় নেই। বছর পেরোলে বিধানসভার ভোট। মরিয়া মুখ্যমন্ত্রী তাই বাম আমল এবং কেন্দ্রের একাধিক প্রকল্পকেই ‘রাজ্যে নতুন বিনিয়োগ’ বলে ঘোষণা করেছিলেন বুধবার। বৃহস্পতিবার সেই পথেই আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে গিয়েছেন তিনি। মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা শোনার পরে সম্মেলন শেষে অনেক প্রতিনিধিরই মন্তব্য, “লক্ষ-কোটি টাকা বিনিয়োগের কথা শুনলাম। কিন্তু প্রায় কিছুই মগজে ঢুকল না!”
কী বিনিয়োগ আসতে চলেছে রাজ্যে? অন্তত মুখ্যমন্ত্রীর দাবি অনুযায়ী।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা সেল ঠিক করেছে, ২০২৫ সালের মধ্যে বিভিন্ন রাজ্যে ইস্পাত প্রকল্পের সম্প্রসারণ করবে। এর মধ্যে রয়েছে দুর্গাপুরের প্রকল্পও, যেখানে আনুমানিক ৪০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করতে চায় ওই কেন্দ্রীয় সংস্থা। তবে সবটাই এখনও পরিকল্পনা-স্তরে। এই নিয়ে সংস্থার পরিচালন বোর্ড এখনও কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য বিনিয়োগ চূড়ান্ত বলেই ঘোষণা করে দিয়েছেন।
সাগরে গভীর সমুদ্রবন্দরের নাম সম্প্রতি ‘ভোর সাগর’ দিয়েছেন মমতা। কিন্তু তাই বলে প্রকল্প নতুন নয়। মোটামুটি দশ বছর আগের। বাম আমলেই ঠিক হয়েছিল, এই প্রকল্পে কেন্দ্র দেবে ৭৪% অর্থ, বাকি ২৬% রাজ্য সরকার। তবে কাজ কিছু এগোয়নি। এখন ১২ হাজার কোটি টাকা ব্যয় হবে জানিয়ে এই প্রকল্পটিই নতুন বলে ঘোষণা করেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
বীরভূমের দুই গ্রাম দেউচা-পাঁচামির মাটির নীচে বিপুল কয়লা রয়েছে। সম্প্রতি এই খনি থেকে কয়লা উত্তোলনের দায়িত্ব রাজ্যকে দিয়েছে দিল্লি। ঠিক হয়েছে, পশ্চিমবঙ্গ-সহ ছ’টি রাজ্য এখান থেকে কয়লা পাবে। গত বছর নিজেদের গোঁয়ার্তুমিতে একটি কয়লাখনি হাতছাড়া করলেও দেউচা-পাঁচামি প্রকল্পে সায় দেয় নবান্ন। ঠিক হয়, দিল্লিতে ৫ জানুয়ারি ছয় রাজ্যের প্রতিনিধিরা চুক্তি সই করবেন। নবান্নের খবর, সে কথা জানতে পেরে বেঁকে বসেন মুখ্যমন্ত্রী। শেষ পর্যন্ত তাঁর ইচ্ছেতেই দিল্লির বদলে সম্মেলন-মঞ্চে চুক্তির ব্যবস্থা হয়। অনেকের মতে, বাম আমলেও কেন্দ্র অনেক কয়লাখনি রাজ্যকে দিয়েছে। কিন্তু কখনওই ‘রাজ্যে বিনিয়োগ এল’ বলে ঢাকঢোল পেটানো হয়নি। যা হল এ বার!
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণায় রয়েছে ডক-রাস্তা-জলপথের মতো কেন্দ্রীয় প্রকল্পও। কলকাতা থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত প্রায় ৬০০ কিলোমিটার জাতীয় সড়ক বানাবে কেন্দ্র। হলদিয়া-বারাণসী জলপথে পরিবহণ পরিষেবা চালু করতে চায় দিল্লি। রয়েছে হলদিয়া বন্দরে ডক নির্মাণের প্রকল্পও। সব মিলিয়ে ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের সম্ভাবনা। এবং সবটাই কেন্দ্রের টাকায়।
রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থা এনটিপিসি বর্ধমানের কাটোয়ায় যে বিদ্যুৎ প্রকল্প করবে, সেখানে বিনিয়োগ ধরা হয়েছে ২০ হাজার কোটি টাকা। এই প্রকল্পটিও বাম আমলের। অর্ধেক জমি অধিগ্রহণও হয়েছে তাদের সময়েই। তবে এখনও নির্মাণ শুরু হয়নি।
আবার, অন্ডালে দেশের মধ্যে প্রথম বিমাননগরী নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমলে। তখনই দু’হাজার একর জমি অধিগ্রহণ করা হয়। কাজও শুরু হয়ে যায়। সেই প্রকল্পকেও তাঁর আমলে আসা লগ্নি বলে দেখিয়েছেন মমতা।
হুগলিতে হিন্দমোটর কারখানার উদ্বৃত্ত জমিতে উপনগরী করার সিদ্ধান্তও বাম আমলের। বিরোধী থাকাকালীন এই প্রকল্পের নানা দিক নিয়ে সরব ছিল তৃণমূল। এখন তারাই নতুন করে চুক্তি করল।
একটি রাজ্যের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে থাকে মূলত উৎপাদন শিল্পের উপর। এই ধরনের শিল্পকে ঘিরে অনেক ছোট ছোট শিল্পও হয়। অতীতে যেমনটা হয়েছে হলদিয়া, কল্যাণীতে। যেমনটা হতে পারত সিঙ্গুরে। ঢাকঢোল পিটিয়ে, বক্তৃতা করে দু’দিনে সরকারের তরফে অনেক ভাল ভাল কথা বলা হলেও বড় মাপের নতুন কোনও উৎপাদন শিল্প তৈরির জন্য লগ্নির হদিশ মেলেনি। তাই প্রশ্নটা থেকেই যাচ্ছে, মুখ্যমন্ত্রী-অর্থমন্ত্রীর ডাকে কিছু বিদেশি-সহ শতাধিক প্রতিনিধি সম্মেলনে এলেও তাঁদের সঙ্গে নতুন বিনিয়োগ কতটা এল?
প্রত্যাশিত ভাবেই মুখ্যমন্ত্রীর দাবির কড়া সমালোচনা করেছেন বিরোধীরা। সংশোধিত লগ্নির অঙ্ক জানার আগেই এ দিন বিজেপি নেতা সিদ্ধার্থনাথ সিংহ বলেন, ৯৩ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের দাবির মধ্যে ৭৮ হাজার ৭০০ কোটি টাকাই কেন্দ্র দেবে। সে জন্য এই সম্মেলনের নাম ‘বিশ্ববঙ্গ বাণিজ্য সম্মেলন’ না হয়ে হওয়া উচিত ছিল ‘সেন্টার এড সামিট’।
বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্রও বলেন, “এই সম্মেলনকে পর্বতের মূষিক প্রসব ছাড়া কিছুই বলা যাচ্ছে না। মুখ্যমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রী যা কিছু বলেছেন, সবই হচ্ছে-হবে প্রস্তাব। ফ্রন্টের শেষ তিন বছরে চার হাজার কোটি, আট হাজার কোটি, ১৬ হাজার কোটি এই ভাবে বিস্তার লাভ করেছিল শিল্প। এই আমলে শিল্প আসা কঠিন। উনি (মুখ্যমন্ত্রী) উৎপাদন শিল্প (সিঙ্গুর) তাড়িয়েছিলেন। সরকার থেকে ওঁকে না-তাড়ালে উৎপাদন শিল্পে আর কিছু হওয়ার নয়।”
রাজ্যে শিল্পের জন্য কত টাকার বিনিয়োগ হয়েছে, কারাই বা বিনিয়োগ করেছে সে ব্যাপারে ‘শ্বেতপত্র’ প্রকাশের দাবি জানিয়ে কংগ্রেস বিধায়ক মানস ভুঁইয়া বলেন, “প্রাক্তন শিল্পমন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছিলেন ১ লক্ষ ৩০ হাজার কোটি বিনিয়োগ হবে। বর্তমান শিল্পমন্ত্রী অমিতবাবু বলেছেন ৭৮ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হচ্ছে। অথচ সম্মেলনে মুখ্যমন্ত্রী বললেন, ৯৩ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ হবে। কোন তথ্য ঠিক, আমরা বিভ্রান্ত!”
তা হলে কি সত্যিই নতুন কোনও লগ্নি এল না? নবান্নের খবর, এসেল নামে এক বেসরকারি সংস্থা পরিকাঠামো উন্নয়নে ১৫ হাজার কোটি টাকা, জার্মানির একটি সংস্থা হাওড়ায় কঠিন বর্জ্য পুনর্ব্যবহার প্রকল্পে ৩৭ হাজার কোটি টাকা, স্কোমি নামে মালয়েশিয়ার একটি সংস্থা অন্ডালে মোনোরেল তৈরির জন্য প্রায় ১৪০০ কোটি টাকা, সিঙ্গাপুরের পরামর্শদাতা সংস্থা সুরবানা ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগের প্রস্তাব দিয়েছে।
উপনগরী তৈরির কয়েকটি প্রকল্প কয়েক বছর আগে কাজ শুরু করেও বিশেষ এগোতে পারেনি। তার পরেও আরও ২২টি উপনগরী তৈরির প্রস্তাব এসেছে বলে জানানো হয়েছে। বিনিয়োগ ধরা হয়েছে ৭২ হাজার কোটি টাকা। নবান্নের খবর, উপনগরী প্রকল্প যে সব সংস্থা করবে, তাদের সিলিং-অতিরিক্ত জমি রাখতে দিতে বাড়তি তৎপরতায় ভূমি আইনের ১৪ওয়াই ধারায় অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
মমতা এ দিন দাবি করেন, “অনেক মউ স্বাক্ষর হয়েছে। অনেকে লগ্নির প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বন্যার মতো এসেছে তারা।” এখানেই না-থেমে তাঁর মন্তব্য, “আরও অনেক প্রস্তাব এসেছিল। অনেকেই জানিয়েছিলেন, তাঁরা প্রস্তুত ছিলেন। তাই তিন লক্ষ কোটি টাকার প্রস্তাব বলতে পারতাম। কিন্তু সরকারি ভাবে যা হয়েছে, সেটাই বলব।” এত বিনিয়োগের হাত ধরে দু’তিন বছরের মধ্যেই রাজ্যে এক কোটি লোকের কর্মসংস্থান হবে বলেও দাবি করছেন তিনি।
যদিও কেন্দ্রীয় শিল্প-বাণিজ্য মন্ত্রকের পরিসংখ্যান জানাচ্ছে, লগ্নির প্রস্তাব যা-ই হোক, প্রকল্প রূপায়ণের হিসেবে পশ্চিমবঙ্গ ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। ২০১২ সালে এ রাজ্যে মাত্র ৩১২ কোটি টাকার প্রকল্প রূপায়ণ হয়েছিল। যা ২০১১ সালের তুলনায় ৮৫% কম। আর বামফ্রন্টের শেষ বছরের তুলনায় ৯৭% কম।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy