হয় প্রথম দিনেই মুখ পুড়বে। নয়তো জোর গলায় নৈতিক জয়ের দাবি করতে পারবে তৃণমূল ও তাদের সরকারের নেতারা। সিবিআই তদন্তে সুপ্রিম কোর্টের নজরদারি চেয়ে রাজ্য সরকার ও তৃণমূল গত কাল যে আবেদন করেছে, শীর্ষ আদালতে তার শুনানি হবে পরশু। আদালত কি এই মামলা বিস্তারিত শুনানির জন্য গ্রহণ করবে সে দিন? এরই উত্তর খুঁজতে গিয়ে দু’টি সম্ভাবনার কথা বলছেন আইনজীবী ও তৃণমূল-সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা।
তবে একটি বিষয়ে মোটামুটি একমত প্রায় সকলেই। তা হল, রাজ্য সরকার ও তৃণমূলের সামনে চ্যালেঞ্জটা কঠিন। সিবিআইকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করার যে অভিযোগ তারা এনেছে, সেটা তাদেরই প্রমাণ করতে হবে। কিন্তু আদৌ সেই সুযোগ তারা পাবে কি না, সেটাই স্পষ্ট হয়ে যাবে পরশুর শুনানিতে। সন্দেহ নেই সারদা তদন্তের জাল ক্রমেই দল ও রাজ্য সরকারের উপরের দিকে উঠে আসছে দেখে মরিয়া হয়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দল ও সরকারকে এই ঝুঁকিটা নিতে হয়েছে। কিন্তু বিপদ থেকে বের হতে গিয়ে উল্টো বিপদে পড়ার ঝুঁকি রয়েছে এতে। আবার এই পথে রাজনৈতিক ফায়দা তোলার সুযোগও মিলে যেতে পারে।
বিপদটা ঠিক কী?
মুখ্যমন্ত্রী থেকে শুরু করে তৃণমূল নেতৃত্ব বেশ কিছু দিন ধরেই অভিযোগ তুলছেন, নরেন্দ্র মোদী সরকার তথা বিজেপি সিবিআইকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কাজে লাগাচ্ছে। এ বার শীর্ষ আদালতে রাজ্য সরকার ও তৃণমূলকে বোঝাতে হবে, তাদের অভিযোগের মধ্যে সারবস্তু রয়েছে। প্রমাণ করতে হবে, সিবিআই সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে কাজ করছে না। কেন্দ্রীয় সরকার তথা বিজেপি নেতাদের কথায় কাজ করছে তারা। অভিযোগের সপক্ষে যথেষ্ট তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বিচারপতিদের সন্তুষ্ট করতে হবে তাদের। শীর্ষ আদালত যদি তাদের যুক্তি-প্রমাণে সন্তুষ্ট না হয়, খারিজ করে দেয় অভিযোগ? আইনজীবীরা তো বটেই, তৃণমূলের নেতারাও মানছেন, প্রথম দিনেই মামলা খারিজ হয়ে গেলে মুখ পুড়বে দলের। রাজ্য সরকারেরও। তখন আর কিছু বলার মুখই থাকবে না তৃণমূল নেতৃত্বের।
আর যদি আদালত মামলা শুনতে রাজি হয়, রাজ্য সরকার ও তৃণমূলের অভিযোগ সম্পর্কে সিবিআই বা কেন্দ্রীয় সরকারের মতামত জানতে চায়, তাতে তাঁদেরই নৈতিক জয় হবে বলে মনে করছেন তৃণমূল নেতারা। সিবিআইকে রাজনৈতিক ভাবে কাজে লাগানোর অভিযোগ সুপ্রিম কোর্টও পরোক্ষে মেনে নিয়েছে বলে তৃণমূল নেতারা দাবি করতে পারবেন। মুকুল রায় নিজে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত দিল্লিতে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও তৃণমূল, দু’পক্ষেরই অভিযোগ, তদন্তের তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছে সিবিআই। বিজেপি নেতারা সিবিআই তদন্তের সম্পর্কে সংবাদমাধ্যমে যে ভবিষ্যৎবাণী করছেন, তা-ই মিলে যাচ্ছে। তৃণমূলের এ-ও অভিযোগ যে, কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারে অস্থিরতা তৈরির জন্য সিবিআইকে কাজে লাগাচ্ছে। নিজেদের দাবির সপক্ষে আজ অতিরিক্ত নথিপত্র জমা দিয়েছে রাজ্য সরকার ও তৃণমূল। বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের প্রতিলিপি পেশ করা হয়েছে।
কোনও রাজ্যের সরকার এবং শাসক দল সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রীয় সরকার ও কেন্দ্রীয় সংস্থার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলছে, এমনটা সচরাচর দেখা যায় না। ফলে রাজনীতিকদের মধ্যে শুধু নয়, আইনজীবীদের মধ্যেও এই মামলা ঘিরে যথেষ্ট কৌতূহল তৈরি হয়েছে। সংবিধান বিশেষজ্ঞ সুভাষ কাশ্যপ বলেন, “আদালতের বিচারাধীন বিষয় বলে এই মামলা সম্পর্কে এখনই কিছু মন্তব্য করব না। কিন্তু কেন্দ্রের বিরুদ্ধে কোনও রাজ্য অভিযোগ তুললে সুপ্রিম কোর্ট তা খতিয়ে দেখতেই পারে। নির্ভর করছে, সেই অভিযোগ কী ধরনের, তার উপর।” আইন-বিশেষজ্ঞ বিশ্বজিৎ দেব বলেন, “আদালতে যে অভিযোগ তোলা হচ্ছে, তার ভিত্তি আছে বলে প্রমাণ করার দায় অভিযোগকারীরই।”
তবে অভিযোগের সারবত্তা আছে প্রমাণ করতে পারলেও কিন্তু আর এক বিপদের মুখে পড়তে হবে মমতা সরকার ও তাঁর দলকে। পরশু মামলার শুনানি হলে, রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধেও পাল্টা অভিযোগ উঠবে সিবিআইয়ের তদন্তে বাধা দেওয়ার। এর আগে সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআই তদন্ত চেয়ে জনস্বার্থ মামলায় যিনি শীর্ষ আদালতে সওয়াল করেছিলেন, সেই আইনজীবী বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যও আদালতে হাজির থাকবেন। বুধবার রাতেই দিল্লি পৌঁছচ্ছেন তিনি। যাঁর উদ্যোগে ওই জনস্বার্থ মামলা হয়েছিল, সেই কংগ্রেস নেতা আবদুল মান্নানের উদ্যোগে একটি আদালত অবমাননারও মামলা হয়েছে মুখ্যমন্ত্রী ও রাজ্যের মন্ত্রীদের বিরুদ্ধে। তাতে অভিযোগ করা হয়েছে, সিবিআইয়ের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে মুখ্যমন্ত্রী ও মন্ত্রীরা আদালত অবমাননা করেছেন। কারণ সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই ওই তদন্ত চলছে। মান্নান আজ এই প্রসঙ্গে বলেন, “আমরা তো প্রথমেই সুপ্রিম কোর্টের নজরদারি চেয়েছিলাম। সে সময় রাজ্য বিরোধিতা করেছিল। এখন আবার তারাই শীর্ষ আদালতের নজরদারি চাইছে। রাজ্যের মন্ত্রীকে গ্রেফতার করার পর মুখ্যমন্ত্রী রাস্তায় নামছেন। সেই মন্ত্রী আদালতে বসে মোবাইলে কথা বলছেন। এসবই সুপ্রিম কোর্টে জানানো হবে।”
এটাই আশঙ্কায় রাখছে রাজ্য সরকারকে। সিবিআই তদন্তের বিরুদ্ধে মুখ্যমন্ত্রী বা রাজ্যের মন্ত্রীদের রাস্তায় নামার অভিযোগ সুপ্রিম কোর্টে পৌঁছলে সেই অভিযোগকে হাতিয়ার করে কলকাতার বাইরে মামলা সরিয়ে নিয়ে যাওয়ার দাবি তুলতে পারে কেন্দ্রীয় তদন্তকারী সংস্থাটি। পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্রকে গ্রেফতারের পর আদালতে তৃণমূল সমর্থকদের গণ্ডগোলের পরে সিবিআই-কর্তারা এমন ভাবনাচিন্তা শুরুও করেছিলেন।
আদালত জানতে চাইলে রাজ্য সরকারের অভিযোগ খণ্ডনে কী বলবে সিবিআই? রাজ্য সরকার অভিযোগ তুলেছে, সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশ মেনে সিবিআই এখনও সারদার বিরুদ্ধে রাজ্যে নথিভুক্ত সমস্ত মামলা হাতে নেয়নি। অন্যান্য সংস্থার বিরুদ্ধেও তারা সব অভিযোগের তদন্ত করছে না। সিবিআই সূত্রে বলা হচ্ছে, আর্থিক কেলেঙ্কারির পিছনে যে বৃহত্তর রাজনৈতিক ষড়যন্ত্র, সেটাই তাদের পাখির চোখ। তবে অন্য বেশ কিছু সংস্থার বিরুদ্ধেও তদন্ত শুরু হয়েছে। মঙ্গলবারও একটি সংস্থার কর্তাদের বাড়িতে তল্লাশি হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে অগুণতি অর্থলগ্নি সংস্থার বিরুদ্ধে পাঁচশোরও বেশি অভিযোগ রয়েছে। সব তদন্ত একসঙ্গে, একই গতিতে চলা সম্ভব নয়। তাই ধাপে ধাপেই এগোনো হচ্ছে। সারদা-তদন্তেও সেটা ঘটছে। আদালতকে এ কথাই জানানো হবে বলেই সিবিআই সূত্রের খবর।
মমতা সরকার ও তৃণমূল তাদের দিকে আঙুল তুললেও তাদের মূল দাবি, অর্থাৎ তদন্তে শীর্ষ আদালতের নজরদারি নিয়ে আপত্তি নেই বলেই জানিয়েছেন সিবিআই অফিসারদের একটি অংশ। টুজি স্পেকট্রাম ও কয়লা খনি বণ্টন কেলেঙ্কারির তদন্ত তারা সে ভাবেই করেছে। এমন ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট সময় অন্তর আদালতে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে রিপোর্ট দিতে হয়। কোনও সন্দেহভাজনকে হেফাজতে নিয়ে জেরা করার প্রয়োজন হলেও আদালতের অনুমতি নিয়ে নেয় সিবিআই। আবার কোনও অভিযুক্তকে গ্রেফতার করা হবে কি না, সে বিষয়েও আদালতের নির্দেশ চাওয়া হয়। সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশেই টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী এ রাজাকে গ্রেফতার করেছিল সিবিআই। তাঁকে ১৫ মাস জেলে কাটাতে হয়েছিল। কাজেই সুপ্রিম কোর্টের নজরদারিতে তদন্ত করতে কোনও অসুবিধা নেই বলেই সিবিআই অফিসারদের দাবি।
তবু কেন শীর্ষ আদালতের নজরদারি চাইছেন তৃণমূল নেতৃত্ব? তাঁদের যুক্তি, তদন্তের ফল কী হবে সে পরের কথা, তবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মুকুল রায় বা দলের অন্য নেতাদের সন্দেহভাজন তকমা দিয়ে জেলে পোরার পথটা অন্তত বন্ধ হবে এতে। এর আগে টুজি বা কয়লা কেলেঙ্কারির তদন্তে ইউপিএ সরকারের তরফে নাক গলানোর চেষ্টা হয়েছিল। সুপ্রিম কোর্টের শাসন ছিল বলেই তা সম্ভব হয়নি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy