ছিলেন সাংবাদিক। তাই কোন খবর শিরোনাম হতে পারে, ভালই জানেন। নিজের দাবিদাওয়া নিয়ে আলোড়ন ফেলে দেওয়ার বিচিত্র সব কৌশলকে প্রায় শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছেন তিনি। হাসপাতালে থাকাকালীনও যেটুকু সুযোগ পেলেন, তা কাজে লাগিয়ে হইচই ফেলে দেওয়ায় একশো শতাংশ সফল তৃণমূলের সাসপেন্ডেড সাংসদ কুণাল ঘোষ।
শনিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত এসএসকেএম হাসপাতালে নাটকীয় কায়দায় প্রচারমাধ্যমের সব আলো কুণাল শুষে নিয়েছেন নিজের দিকে। কখনও ঠাসা প্রহরার মধ্যেই অ্যাম্বুল্যান্সের দরজা ধরে ঝুলে পড়ে চিৎকার করে নিজের দাবি জানিয়েছেন। আবার কখনও শারীরিক পরীক্ষা করাবেন না বলে বেঁকে বসেছেন। তাঁকে সামলাতে গিয়ে এ দিন এতটাই নাস্তানাবুদ হয়েছেন পুলিশ এবং এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ যে, শারীরিক অবস্থার উন্নতি সত্ত্বেও কুণালকে ক্রিটিক্যাল কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) থেকে সাধারণ কেবিনে সরানোর সাহস দেখাননি তাঁরা।
অনেকেই বলছেন, জেলবন্দি থাকলেও তাঁর অভিযোগ বা দাবিদাওয়া যাতে অন্য খবরের ভিড়ে ধামাচাপা পড়ে না যায়, সে ব্যাপারে অত্যন্ত সচেতন কুণাল। সে জন্য মাঝেমধ্যেই ‘চমক’ দেন। এতে প্রশাসন যেমন অস্বস্তিতে থাকে, তেমনই জনমানসে কুণাল নিজেও সহজে ফিকে হন না। সাম্প্রতিক অতীতে একাধিক বার জেল থেকে আদালতে যাতায়াতের সময় পুলিশ ভ্যানের পা-দানিতে দাঁড়িয়ে বা জাল দেওয়া জানলা দিয়ে তিনি চিৎকার করে বিবৃতি দিয়েছেন। অবস্থা এমনই হয়েছে যে টানাহেঁচড়া করে কুণালকে দমাতে না পেরে কোর্ট চত্বরে ভ্যানের গা চাপড়ে সমস্বরে ‘হারেরেরে...’ বলে চেঁচিয়েছে পুলিশবাহিনী। যাতে ঢাকা পড়ে যায় কুণালের কণ্ঠস্বর। কখনও সংবাদপত্রে কুণালের লেখা ডায়েরির পাতা প্রকাশিত হওয়ার পর ‘বিস্ফোরণ’ ঘটেছে, আবার কখনও সারদা-কাণ্ড নিয়ে খোদ মুখ্যমন্ত্রীকেই কাঠগড়ায় তুলে বিতর্কের সুনামি তৈরি করেছেন তাঁর এই একদা প্রিয়পাত্র।
সেই কুণালেরই সাম্প্রতিকতম ঝটকা, আগাম ঘোষণা করে জেলে আত্মহত্যার চেষ্টা। অবশ্য তার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ক্ষীণকণ্ঠে সংবাদমাধ্যমের কাছে প্রশ্ন তুলেছিলেন, “এত ঘুমের ওষুধ আমার কাছে এল কী করে?” এ দিন, শনিবারের বারবেলায় দেখা গেল তিনি আবার স্ব-ফর্মে, পূর্ণ উদ্যমে।
বেলা তখন সওয়া ১১টা। এসএসকেএম হাসপাতালের মেন ব্লকের বাইরে অ্যাম্বুল্যান্স এসে দাঁড়িয়েছে। এক্স রে, ইইজি করতে কুণালকে নিয়ে যাওয়া হবে মিনিট চারেকের দূরত্বে ‘বাঙ্গুর ইনস্টিটিউট অব নিউরোলজি’ (বিআইএন)-তে। ভরা পুলিশ প্রহরায় কুণাল বের হলেন। পরনে হাসপাতালের রোগীদের জন্য নির্দিষ্ট সবুজ অ্যাপ্রন, নাক থেকে নল ঝুলছে। বাইরে তখন গাদা-গাদা সাংবাদিক, ওবি-ভ্যান, বুম, ক্যামেরা।
তাঁকে দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়ল মিডিয়াকুল। আর সঙ্গে সঙ্গে শুরু হয়ে গেল এ দিনের ‘কুণাল-অধ্যায়’।
সবাই কুণালের বক্তব্য চান। পুলিশও একবগ্গা। সাংবাদিকদের ঠেলে, ক্যামেরায় ধাক্কা মেরে, বুম ফেলে দিয়ে তারা টেনেটুনে কুণালকে অ্যাম্বুল্যান্সে ঢোকানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছে। কুণাল এর মধ্যেই চিৎকার করে বলে চলেছেন, “যাঁরা দোষী অবিলম্বে তাঁদের গ্রেফতার করা হোক, ওঁদের গ্রেফতার করতে বলুন। আমি ভাল নেই, একেবারে ভাল নেই। ঘুরে দাঁড়াচ্ছে বাইরে সবাই!”
কোনও মতে কুণালকে তুলে নিয়ে বিআইএন-এ চলে যায় অ্যাম্বুল্যান্স। এসএসকেএমের সামনে জমা ভিড়ে তখন কুণালের ছুড়ে দিয়ে যাওয়া লাইনগুলি নিয়ে জোর জল্পনা। বিশেষ করে ‘ঘুরে দাঁড়াচ্ছে সবাই’ নিয়ে। কেউ বললেন, কুণাল আসলে বোঝাতে চেয়েছেন, তিনি বিদ্রোহী হয়েছেন দেখে আরও অনেকে শাসক দলের বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন। আবার অনেকের ব্যাখ্যা সারদা কাণ্ডে কিছু দিন আগেও তৃণমুলের যে সব হেভিওয়েট নেতা শাস্তির ভয়ে কুঁকড়ে ছিলেন, তাঁরা আবার স্বমহিমায় ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হয়তো তাঁদের দিকেই ইঙ্গিত করেছেন তৃণমূলের সাসপেন্ডেড সাংসদ।
এক দিকে যখন এই আলোচনা, বিআইএন-এ তখন আর এক নাটক। শারীরিক পরীক্ষা করাবেন না বলে বেঁকে বসেছেন কুণাল। অধ্যক্ষ প্রদীপ মিত্রের কথায়, “উনি চরম অসহযোগিতা করেছেন। কিছুতেই পরীক্ষা করাতে ঢুকবেন না। গোঁজ হয়ে বসে বলছেন, ‘আমি তো মরে যেতেই চাই। আবার এই সব পরীক্ষার নাটক কেন হচ্ছে?’ অনেক সাধ্যসাধনার পর প্রায় জোর করে পরীক্ষাগুলো করতে হয়।” ইইজি এবং ডিজিটাল এক্স রে করতেই পেরিয়ে যায় প্রায় দু’ঘণ্টা। বেলা ১টা ১০ নাগাদ তাঁকে আবার অ্যাম্বুল্যান্সে চাপিয়ে নিয়ে আসা হয় এসএসকেএমের মেন বিল্ডিংয়ে।
শুরু হল কুণাল-অধ্যায়ের দ্বিতীয়ার্ধ।
এ বার সংবাদমাধ্যমের সামনে কুণালকে বের করতেই চাইছিল না পুলিশ। টানা প্রায় ২০ মিনিট অ্যাম্বুল্যান্সের মধ্যে দরজা-জানলা আটকে তাঁকে ভিতরে বসিয়ে রাখা হয়। সংবাদকর্মীদের অনেকে অধৈর্য হয়ে অ্যাম্বুল্যান্সের গায়ে-মাথায় চাপড় মেরে বলতে থাকেন, “কুণালদা কিছু বলুন। কুণালদা আপনার উপর কি অত্যাচার হচ্ছে? আপনার শরীর কেমন আছে?” তাঁদের দিকে তেড়ে যেতে থাকে পুলিশ।
অবশেষে ডিসি (সাউথ) মুরলীধর শর্মার নেতৃত্বে আরও বাহিনী আসে। কুণালকে অ্যাম্বুল্যান্স থেকে বের করা হয়। মাত্র ছ’সাত পা দূরে হাসপাতালের দরজা, নাকে নল নিয়েই গাড়ির দরজা খামচে ঝুলে পড়েন কুণাল। আপ্রাণ চেঁচিয়ে বলতে থাকেন, “দোষীরা বাইরে থেকে মামলাকে প্রভাবিত করছে, মামলায় দেরি করাচ্ছে। এঁদের ধরতে বলুন।” এক পুলিশকর্মী তখন উপায়ান্তর না দেখে নিজের টুপিটা খুলে কুণালের মুখ চাপা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা করছেন, এক জন ঘাড় চেপে ধরেছেন, তিন-চার জন হাত-কোমর ধরে টেনে হাসপাতালের দরজায় ঢোকাতে চাইছেন। কুণাল চেঁচিয়ে চলেছেন, “মারছেন কেন? মারছেন কেন? আমাকে মারছে, মারছে!” সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে পুলিশের ধস্তাধস্তি তখন চরমে। এ দিক-ও দিক ছিটকে পড়ছেন অনেকে। শরীরের কষ্ট ভুলে হাসপাতাল চত্বরে স্ট্রেচারে শোওয়া রোগীও সেই হুলস্থুল দেখে উঠে বসে হাঁ করে গিলছেন!
পরে হাওড়ার শরৎ সদনে পুরমন্ত্রী ফিরহাদ (ববি) হাকিমের কাছে কুণালের এ দিনের বক্তব্য নিয়ে জানতে চাওয়া হয়। ফিরহাদ বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী বিধানসভায় প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। এর পরেও একজন আসামি কী বলল না বলল, তা জেলের বাইরে থেকে আপনি শুনতে পারেন। আমি শুনিনি।” কুণালের সেল থেকে পাওয়া ‘সুইসাইড নোট’-এ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, পরিবহণ মন্ত্রী মদন মিত্র ও তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়ের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি তোলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ফিরহাদ বলেন, “সবাই জানেন উনি নাটক করছেন।”
এসএসকেএম কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন, কুণাল যতই ভাল থাকুন, তাঁকে আর সিসিইউয়ের ঘেরাটোপ থেকে বার করার ঝুঁকি নেওয়া হবে না। তাঁর রক্তচাপ, নাড়ির গতি, শরীরে অক্সিজেনের মাত্রা সবই ঠিকঠাক রয়েছে। সমস্ত রিপোর্টও স্বাভাবিক। চিকিৎসকেরা জানিয়েছেন, মাঝেমধ্যে তীব্র মাথার যন্ত্রণা এবং ক্ষণিকের ব্ল্যাকআউট হচ্ছে বলে তাঁর ইইজি করা হয়েছে। এক বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছেন বলে কুণালের বেডের পাশে সর্বক্ষণ পুলিশ-প্রহরা রয়েছে। এমনকী বাথরুমেও যেতে দেওয়া হচ্ছে না তাঁকে। দেওয়া হচ্ছে বেডপ্যান। তবে কুণালের শনিবারের ‘ফর্ম’ দেখে প্রশ্ন উঠছেই যে, ২২-২৩টা ঘুমের ওষুধ খাওয়া লোক কি দেড় দিনের মধ্যে এতটা চাঙ্গা হতে পারেন? চিকিৎসকদের বক্তব্য, কুণাল হয়তো আসলে এত ওষুধ খানইনি। অথবা খেয়ে থাকলেও তাঁর দেহে ওষুধগুলি ঠিকঠাক ‘অ্যাবজর্ব’ হয়নি বলেই চিকিৎসকেরা মনে করছেন।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy