সাংবাদিকদের মুখোমুখি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। শুক্রবার নবান্নে সুদীপ আচার্যের তোলা ছবি।
সারদা-কেলেঙ্কারিতে মদন মিত্র গ্রেফতার হওয়ার পরেই প্রবল আতঙ্ক ছড়িয়েছে তৃণমূলের অন্দরে। কিন্তু ভয় পেয়ে গুটিয়ে যাওয়াটা রাজনৈতিক হারাকিরি হবে বুঝেই প্রতিরোধের ডাক দিয়ে কর্মীদের রাস্তায় নামিয়ে দিতে চাইলেন শাসক দলের শীর্ষ নেতৃত্ব।
সিবিআইয়ের বাউন্সার সামাল দেওয়ার চেষ্টায় শুক্রবার সন্ধ্যায় ব্যাট ধরলেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তার আগে দলনেত্রীর নির্দেশে একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন দলের দুই শীর্ষ নেতা পার্থ চট্টোপাধ্যায় ও সুব্রত মুখোপাধ্যায়।
কিন্তু তৃণমূলের বহু নেতাই একান্তে কবুল করছেন, মদনের হয়ে ব্যাট করা কার্যত অসম্ভব। কারণ, কয়েক বছরে পরিবহণমন্ত্রীর জীবনযাত্রায় চোখে পড়ার মতো যে পরিবর্তন হয়েছে, যে ভাবে বিপুল ধুমধাম করে পারিবারিক অনুষ্ঠান করেছেন তিনি, একের পর এক নামীদামি গাড়িতে সওয়ার হতে দেখা গিয়েছে তাঁর পরিবারের লোকজনকে তাতে জনমানসেই তাঁর স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে গিয়েছে।
তা হলে এই মরিয়া চেষ্টা কেন? ওই নেতাদের বক্তব্য, সিবিআই দফতরে হাজিরা দিতে যাওয়ার আগে মদন ঘনিষ্ঠ মহলে বলে রেখেছেন, ডুবলে তিনি ডালপালা নিয়েই ডুববেন। ফলে এখন তাঁর পাশে না-দাঁড়ালে মদন যদি তাঁর ঝুলি থেকে নানা রকম বেড়াল বার করে দেন! সেই আশঙ্কা মনে নিয়েই তাই সাহসী মুখ দেখিয়ে রাস্তায় নামতে হচ্ছে তৃণমূলকে!
মুখ্যমন্ত্রী এ দিন মদনের গ্রেফতারিকে ‘অনৈতিক, অবৈধ এবং সংবিধান বহির্ভূত’ বলে অভিযোগ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন, আগে তাঁকেই গ্রেফতার করা হোক! পরিবহণমন্ত্রীর ইস্তফা মঞ্জুর করছেন না বলে দাবি করেছেন। ‘ব্যক্তি’ মদনকে সার্টিফিকেট দিয়েছেন। সিবিআইয়ের এক্তিয়ার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। যে আদালতে এই মামলায় ধৃতদের বিচার চলছে, তাদের ‘সিবিআইয়ের ধামাধরা’ (যদিও বিচারক রাজ্যেরই দেওয়া) বলে কটাক্ষ করেছেন। একই সঙ্গে নবান্নে দাঁড়িয়ে বলেছেন, ধৃত মদনকে এসএসকেএম হাসপাতালে আনা হলে এক বার তাঁকে দেখতে যেতে চান।
মদন মিত্রের কুশপুতুল নিয়ে কংগ্রেস কর্মী-সমর্থকদের উল্লাস। পরিবহণমন্ত্রীর গ্রেফতারের
খবর আসার পরে। শুক্রবার বহরমপুরে গৌতম প্রামাণিকের তোলা ছবি।
আপাতদৃষ্টিতে এর মধ্যে মদনের পাশে দাঁড়িয়ে রাজনৈতিক লড়াইয়ের বার্তাই স্পষ্ট। যে লড়াইয়ে কার্যত এ দিন সন্ধ্যা থেকেই পথে নেমে পড়েছে তৃণমূল। কিন্তু দলের মধ্যেই প্রশ্ন, এই লড়াইয়ের কতটা আন্তরিক? আর কতটাই বা ভয়ে? এর আগে শাসক দলের দুই সাংসদ কুণাল ঘোষ ও সৃঞ্জয় বসু গ্রেফতার হওয়ার পরে তাঁদের কাউকে দেখতে যাওয়ার ইচ্ছা হয়নি তৃণমূল নেত্রীর। মদনের ক্ষেত্রে হল কেন? তৃণমূল সূত্রের আনুষ্ঠানিক ব্যাখ্যা, মদনের পাশে তিনি কী ভাবে আছেন, সেই বার্তা নিয়ে কোনও সংশয় রাখতে চাইছেন না মমতা। কিন্তু দলেরই একাংশের মত ভিন্ন। তৃণমূলের এক নেতার কথায়, “তোমার পাশে আছি, তুমি বিগড়ে যেও না মদনদার কাছে সশরীর হাজির হয়ে আসলে এই বার্তাটাই দিতে চাইছেন দিদি!”
মদনের পাশে দাঁড়িয়ে এ দিন মমতা বলেন, “একটা বিপজ্জনক খেলা খেলছে কেন্দ্র। বিজেপির সরকার প্রতিহিংসাপরায়ণ। তাদের নেতা বলে দিয়েছে, মমতা ভাগ, মুকুল ভাগ! এখন সিবিআই অনৈতিক ভাবে গ্রেফতার করছে। আজ আর বাজে কথা বললাম না!” সঙ্গে মমতার সংযোজন, “প্রধানমন্ত্রীকে বলছি, প্রথমে আমাকে ধরো! তোমাদের কাছে আমি তো চোর, ডাকাত! তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ, আমি আজ চোর বটে!”
ঘটনা হল, রাজ্য রাজনীতিতে এই ‘চোরে’র অনুষঙ্গ প্রথম এনেছিলেন তৃণমূল নেত্রীই। সারদা-কাণ্ড প্রকাশ্যে আসার পরে গত বছর দলের বৈঠকে এবং জনসভায় নিজেই বড় মুখ করে বলেছিলেন, “কুণাল চোর? মদন চোর? টুম্পাই চোর? মুকুল চোর? আমি চোর? আর বাকিরা সবাই সাধু?” এই তালিকার প্রথম নাম কুণালকে গত বছরই ধরে রাজ্য সরকারের তৈরি করা বিশেষ তদন্তকারী দল। ক’দিন আগে টুম্পাই অর্থাৎ সৃঞ্জয় বসুকে গ্রেফতার করেছে সিবিআই। এ দিন ধরা হল মদনকে।
স্বাভাবিক ভাবেই বিজেপির শমীক ভট্টাচার্য থেকে বাম বিধায়ক উদয়ন গুহরা বলতে শুরু করেছেন, “রইল বাকি দুই!” আমজনতা থেকে বিরোধী দল এবং খোদ শাসক দলের অন্দরেও এ দিন থেকে জল্পনা বেড়ে গিয়েছে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক মুকুল রায়কে নিয়ে। পরিস্থিতি বুঝেই মুকুলও দিনটা কাটিয়েছেন প্রায় ধরাছোঁয়ার বাইরে। আর এই চাপ মোকাবিলা করতেই মমতা বিজেপি এবং কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, প্রতিহিংসার অভিযোগকে আরও বেশি করে হাতিয়ার করেছেন।
মমতা বোঝাতে চেয়েছেন, পুরভোটকে সামনে রেখেই বিজেপি সিবিআই-কে রাজনৈতিক ভাবে ব্যবহার করে তৃণমূল নেতাদের ফাঁসাচ্ছে। তাঁর কথায়, “বেছে বেছে শুক্রবার এটা করল, যাতে শনি-রবিবার সংসদে কেউ প্রতিবাদ করতে না পারে! দেশের গণতন্ত্র ধ্বংস করতে চাইছে। অন্যেরা মুখ খুলতে ভয় পাচ্ছে।” আজ, শনিবার ময়দানে গাঁধীমূর্তির পাদদেশ থেকে ক্রীড়াপ্রেমীদের মিছিলের ডাক দিয়েছেন মমতা। যদিও তার আগেই এ দিন সন্ধ্যা থেকে কলকাতা-সহ শহরতলির নানা জায়গায় বিক্ষিপ্ত ভাবে রাস্তা অবরোধে নেমে পড়েছে তৃণমূল। যে মমতা ক্ষমতায় আসার আগেই বলেছিলেন তাঁরা বন্ধ-অবরোধে যাবেন না, তাঁর সেই নীতি উড়ে গিয়েছে মদনের ধাক্কায়!
তৃণমূলেরই এক সাংসদ বলছেন, “প্রতিবাদে যাওয়া ছাড়া তো উপায়ও নেই। নইলে পুরো সরকারটাই তো চোর বলে প্রতিপন্ন হয়ে যাবে! তাই চাই বা না চাই, রাস্তায় নামতেই হচ্ছে!” কিছু দিন আগেই কালীঘাটে দলীয় বৈঠকে মমতা বলেছিলেন, মুকুল-মদন চোর, এ কথা তিনি বিশ্বাস করেন না। তৃণমূল নেতাদের একাংশ মনে করিয়ে দিচ্ছেন, সেই কথা থেকে এখন সরে আসা মুশকিল। তায় আবার মদন সিবিআইয়ের কাছে মুখ খুললে বড় বিপদ! তাই কুণাল-রজত মজুমদারদের যেমন অতিথি, বা সৃঞ্জয়কে ‘ল্যাটারাল এন্ট্রি’ বলে হাত ধুয়ে ফেলা গিয়েছিল, মদনের বেলায় তেমন দূরত্ব তৈরি করা যাচ্ছে না!
মদন-ধাক্কা মোকাবিলায় আপাতত আইন, সংবিধান, নীতি এ সব প্রশ্নকেই সামনে আনতে চাইছে তৃণমূল। মমতা যেমন বলেছেন, “এক জন মন্ত্রীকে গ্রেফতার করে নিয়ে চলে গেলে! সরকারকে কিছু জানালে না! এটা হতে পারে?” ঘনিষ্ঠ মহলে মুখ্যমন্ত্রী বলেছেন, মদনকে সিবিআই গ্রেফতার করেছে বিকেল চারটেয় অথচ রাজ্য সরকারকে জানানো হয়েছে রাত ৭টা ৩৯ মিনিটে। এটা বেআইনি। মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে এবং তাঁরই সুরে বর্ষীয়ান মন্ত্রী সুব্রতবাবুও বলেছেন, “যে ভাবে রাজ্যের এক জন মন্ত্রীকে জেরার নাম করে ডেকে গ্রেফতার করা হয়েছে, তা রাজনৈতিক প্রতিহিংসা বলেই আমরা মনে করছি। ওঁকে গ্রেফতারের আগে কাউকে জানানো হয়নি। না সরকারকে, না বিধানসভার স্পিকারকে!”
বিধানসভাকে অন্ধকারে রেখে মন্ত্রী মদনকে গ্রেফতার করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়ও। তাঁর বক্তব্য, “বিধানসভার অধিবেশন মুলতবি আছে। এখনও ‘প্রোরোগ’ হয়নি। এই অবস্থায় মন্ত্রিসভার এক জন সদস্যকে ফৌজদারি মামলায় গ্রেফতার করতে গেলে অবশ্যই স্পিকারকে জানাতে হবে। কিন্তু সে সব কিছুই করা হয়নি। এটা অনৈতিক।” এর বিরুদ্ধে বিধানসভায় নিন্দা প্রস্তাব, অধিকার ভঙ্গের নোটিস বা অন্য কোনও পদক্ষেপের কথাও ভাবছে সরকারি শিবির।
তবে মুখ্যমন্ত্রী যে ভাবে মদনের গ্রেফতারিকে অসাংবিধানিক এবং আইন বহির্ভূত বলেছেন, তাকে ‘হাস্যকর’ বলে উড়িয়ে দিয়েছেন বিরোধীরা। তাঁদের যুক্তি, সিবিআই কাজ করছে সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে। তাদের সিদ্ধান্তকে ‘বেআইনি’ বলার মানে আসলে সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশ নিয়েই প্রশ্ন তোলা।
সুব্রতবাবু এ দিন বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের দিকেও আঙুল তুলেছেন। তাঁর অভিযোগ, কলকাতায় সভা করতে এসে অমিত সিবিআইয়ের সঙ্গে বৈঠক করেন। তখনই মদনকে গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া হয়। যে অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছে বিজেপি।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy