প্রচারের ফাঁকে আসানসোলে বাবুল সুপ্রিয়। নিজস্ব চিত্র।
বেলা সাড়ে ১২টা। দমদমে ঢুকছে বনগাঁ-ক্যানিং লোকাল। হঠাৎই ধপ করে মেঝেতে পড়ে গেলেন দাঁড়িয়ে থাকা এক যুবক! নিমেষে হইচই পড়ে গেল ট্রেনের কামরায়। মাথায়-ঘাড়ে জল দেওয়ার পরে ধাতস্থ হলেন তিনি।
কাকা আর দুই খুড়তুতো ভাইয়ের সঙ্গে চিড়িয়াখানায় এসেছিল নবম শ্রেণির শ্রেয়া দাস। বেলা আড়াইটেয় জলহস্তীর খাঁচার সামনে হঠাৎই মাথা ঘুরে পড়ে গেল সে। ঘাড়ে-মাথায় জল দিয়ে সুস্থ করা হল তাকে।
চড়া গরমে রাস্তাঘাটে অসুস্থ হয়ে পড়ার এই ছবিটা এপ্রিল-মে মাসের কলকাতায় বিরল নয়। এ বার কিন্তু সেই দহন-দাপট মার্চেই! আট বছর পরে শেষ মার্চে অর্থাৎ মাঝ-চৈত্রে ফের তাপপ্রবাহের কবলে পড়ল মহানগর। শনিবার কলকাতায় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩৯.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। রবিবার তা বেড়ে হয় ৩৯.৯ ডিগ্রি, স্বাভাবিকের থেকে ছয় ডিগ্রি বেশি। সর্বোচ্চ তাপমাত্রা স্বাভাবিকের থেকে পাঁচ ডিগ্রি বা তার বেশি হলে আবহবিজ্ঞানের পরিভাষায় সেটাকে বলা হয় তাপপ্রবাহ (দিনের পারদ ৪০ ডিগ্রির বেশি হতে হবে)। হাওয়া অফিস জানিয়েছে, এ দিনের পরে গত এক দশকের গরমের নিরিখে দ্বিতীয় জায়গায় পৌঁছেছে এ বারের মার্চ। প্রথম স্থানে রয়েছে ২০০৬-এর ২৬ মার্চ। মহানগরের পারদ সে-দিন ৪০.৬ ডিগ্রি ছুঁয়েছিল।
শুধু কলকাতা নয়, দক্ষিণবঙ্গের সব জেলাতেই প্রতাপ বেড়েছে পারদের। হাওয়া অফিস সূত্রের খবর, দক্ষিণবঙ্গের জেলাগুলির মধ্যে সব থেকে বেশি তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে বাঁকুড়ায়, ৪১.৫ ডিগ্রি। এ দিন কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গের প্রায় সব জেলাতেই তাপপ্রবাহের সতর্কতা জারি করেছে আলিপুর আবহাওয়া দফতর। বাঁকুড়া, বীরভূম, পুরুলিয়ার মতো জেলাগুলিতে ‘লু’ বা গরম হাওয়া বইছে। ওই দফতরের অধিকর্তা গোকুলচন্দ্র দেবনাথ জানান, আজ, সোমবারেও কলকাতা-সহ দক্ষিণবঙ্গে তাপপ্রবাহ চলবে। আর পশ্চিমাঞ্চল জুড়ে চলতে থাকবে ‘লু’-র দাপট।
বাঁকুড়ায় গরম হাওয়া বইতে শুরু করেছিল শুক্রবার থেকেই। এ দিন তা তীব্র হয়েছে। ঘণ্টায় ২০ কিলোমিটার বেগে ‘লু’ বয়েছে সেখানে। তবে গরমে অসুস্থ হয়ে পড়ার খবর নেই বলেই জেলা স্বাস্থ্য দফতর জানিয়েছে। গরমে বাঁকুড়া, আসানসোলের মতো পশ্চিমের বিভিন্ন এলাকায় রাস্তাঘাট প্রায় ফাঁকা। দিনের বেলা কার্যত মাছি তাড়াচ্ছে চৈত্র সেলের দোকানগুলিও।
বাঁকুড়ার মতো পশ্চিমের জেলাগুলোয় এমন শুষ্ক গরম অবশ্য অপরিচিত নয়। হাওয়া অফিস বলছে, শেষ মার্চে এমন তাপমাত্রা আগেও দেখেছে বাঁকুড়া। ২০১০ সালের ২৪ মার্চ তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি পেরিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু কলকাতা বা সংলগ্ন দক্ষিণবঙ্গে এতটা শুকনো গরম খুব স্বাভাবিক নয়। মহানগরীতে এ বারের গরম এমন ‘শুষ্ক’ কেন?
আর্দ্রতার খামখেয়ালকেই দায়ী করছেন আবহবিদেরা। তাঁরা বলছেন, এ বার আর্দ্রতা অনেক নীচে নেমে গিয়েছে। রবিবার কলকাতায় ন্যূনতম আর্দ্রতা ছিল ২৯%। তাপমাত্রার দাপট ঊর্ধ্বমুখী আর আর্দ্রতা নিম্নমুখী। দুইয়ে মিলিয়েই দুঃসহ শুষ্ক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। রাস্তায় বেরোলে এই শুকনো গরম জ্বালা ধরাচ্ছে চোখে-নাকে-মুখে। ভোটের মুখে রবিবার দিনটা প্রার্থীরা আলাদা করে প্রচারে জোর দিয়ে থাকেন। গরম এ দিন তাঁদেরও কাহিল করেছে। প্রচারে বেরিয়ে কেউ ঘন ঘন জল খেয়েছেন, কেউ চুমুক দিয়েছেন ফলের রসে। কর্মী-সমর্থকরা ছাতা-টুপিতে মাথা ঢেকে, মুখে রুমাল বেঁধে রোদের জ্বালা থেকে বাঁচার চেষ্টা করেছেন। পুরুলিয়ার প্রবীণ কংগ্রেস প্রার্থী নেপাল মাহাতো এলাকায় ঘুরতে ঘুরতে বলছিলেন, “গরম যতই পড়ুক, ভোটের সময় রবিবার কেউ বাড়িতে বসে থাকতে পারে? কষ্ট হলেও বেরোতে হবেই।”
এই গরমেই আজ, সোমবার পশ্চিম মেদিনীপুরে যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। সেখানেও তাপমাত্রা চল্লিশ ডিগ্রি ছাড়িয়েছে। তিন প্রার্থীর সমর্থনে কেশিয়াড়ি, গড়বেতা এবং কেশপুরে তিনটি সভা করবেন তৃণমূল নেত্রী। রোদ চড়া থাকলে ভিড় কী ভাবে হবে, কেউ অসুস্থ হয়ে পড়লেই বা কী হবে রবিবার সভার প্রস্তুতি-পর্বে সে কথাই ভাবিয়েছে জেলা নেতৃত্বকে। পরিস্থিতি দেখে দলীয় কর্মীদের ছাতা-টুপি সঙ্গে নিয়ে সভায় যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন জেলা নেতারা। সঙ্গে জল রাখতেও বলেছেন, পারলে নুন-চিনির জল। জেলা তৃণমূল সভাপতি দীনেন রায় বলেন, “চৈত্রের মাঝমাঝি এই গরম ভাবা যায় না। কর্মীদের জল-ছাতা সঙ্গে রাখতে বলেছি। সভায় যাঁরা আসবেন, তাঁদেরকেও এ কথা জানিয়ে দিতে বলেছি।” সভাস্থলের সামনের দিকে কিছুটা ছাউনি তৈরি করা হচ্ছে। যাতে সরাসরি রোদটা অন্তত এড়ানো যায়। জেলা তৃণমূলের এক নেতা বলছিলেন, “কর্মীদের সুতির জামাকাপড় পরার কথা বলেছি। আবহাওয়ার সঙ্গে আমাদের সকলকেই মানিয়ে নিতে হবে।”
একই সমস্যায় বাঁকুড়ার তৃণমূল নেতারাও। পয়লা এপ্রিলেই জেলায় ঢোকার কথা তারকা প্রার্থী মুনমুন সেনের। এমন পাগল-পারা গরমে প্রার্থীকে সুস্থ রাখা নিয়েই দুশ্চিন্তায় রয়েছেন তাঁরা। মাঝে একবার এসে কর্মিসভা করে ফিরে গিয়েছেন মুনমুন। জেলার এক নেতা বলছিলেন, “ওই দিন উনি বাঁকুড়ার বিখ্যাত গরম তেমন টের পেলেন কই! এ বার তো উনি আসছেন তিন-চার দিনের জন্য। ভালয় ভালয় সব মিটলে বাঁচি!”
এ বার মার্চের শেষে আর্দ্রতা এতটা কৃপণ হয়ে পড়ল কেন?
বঙ্গোপসাগর থেকে জলীয় বাষ্পের জোগান কমে যাওয়াটাই এই অস্বাভাবিক পরিস্থিতির কারণ বলে জানাচ্ছেন আবহবিদেরা। তাঁরা জানান, কয়েক দিন আগে বঙ্গোপসাগর উপকূলে একটি উচ্চচাপ বলয় ছিল। তা থেকেই জোলো হাওয়া ঢুকছিল দক্ষিণবঙ্গের পরিমণ্ডলে। কিন্তু সেই উচ্চচাপ বলয় দুর্বল হয়ে যাওয়ায় জলীয় বাষ্পের জোগান বন্ধ হয়ে যায়। তার দুর্বলতার সুযোগে উত্তর ভারতের শুষ্ক গরম হাওয়া ঢুকে পড়েছে দক্ষিণবঙ্গে।
কত দিন চলবে শুকনো গরমের এমন দাপট?
বিশেষ আশা দিতে পারছেন না আবহবিদেরা। তাঁদের মতে, সাগরে নিম্নচাপ বা ঘূর্ণাবর্ত তৈরি হলে হাওয়ায় জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বাড়বে। তাতে নাকে-মুখে জ্বালা ধরানো শুকনো ভাবটা কাটবে। আর তাপমাত্রা কমার জন্য দরকার ঝড়বৃষ্টি। “একটা কালবৈশাখী হলেই পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে যাবে,” মন্তব্য এক বিজ্ঞানীর।
কিন্তু রেডার ঢুঁড়েও কালবৈশাখীর ইঙ্গিত পাচ্ছে না হাওয়া অফিস।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy