এখনও বড় বড় হরফে লেখা— ইউ উইশ, উই ফুলফিল।
গুগ্লে গিয়ে সার্চ দিয়ে সুন্দর ঢুকে পড়া যাচ্ছে সারদা গোষ্ঠীর ওয়েবসাইটে। যার ভূমিকায় খোদাই করা ইচ্ছেপূরণের এই প্রতিশ্রুতি। উপর দিয়ে মাথা তুলছে কল্পতরু। গাছের এক-একটা পাতায় গোষ্ঠীর এক-একটা সংস্থার নাম। সেখানে ক্লিক করলে খুঁটিনাটি তথ্য হাতের মুঠোয়!
এক বছর আগে পাট গুটিয়েছে যে সারদা-সাম্রাজ্য, ই-দুনিয়ায় তার অস্তিত্ব এখনও জ্বলজ্বলে! কী ভাবে সম্ভব?
আপাতত সারদা-কেলেঙ্কারির তদন্তে নিয়োজিত রাজ্য পুলিশ বা কেন্দ্রীয় এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)— কেউই ব্যাপারটাকে তেমন গুরুত্ব দিচ্ছে না। “থাক না ওয়েবসাইট। আমাদের তদন্তে তো ক্ষতি করছে না!” বলছেন এক ইডি-অফিসার। বিধাননগর কমিশনারেটের গোয়েন্দা-প্রধান অর্ণব ঘোষেরও যুক্তি, “আমাদের তদন্ত শেষ হয়নি। তা ছাড়া সাইট ব্যবহার করে আর ঠকানো যাবে না। কারণ, তাতে লগ-ইন করলেও সাড়া দেওয়ার মতো কেউ নেই। সারদার কোনও অফিস খোলা নেই।”
বিশেষজ্ঞেরা জানিয়েছেন, ওয়েবসাইটের জন্য ইন্টারনেটে জায়গা ভাড়া নিতে টাকা লাগে। ন্যূনতম এক বছরের জন্য ‘ইন্টারনেট-ডোমেন’ ভাড়া নিতে হয়। চাইলে পাঁচ-দশ বছরের জন্যও ভাড়া নিয়ে রাখা যায়। সারদার ব্যবসা ২০১৩-য় গুটিয়ে গেলেও তাদের সাইটটি ২০১৪-র ডিসেম্বর পর্যন্ত চালু থাকবে বলে জানা গিয়েছে। অর্থাৎ দু’বছর বা তার বেশি সময়ের জন্য ডোমেন ভাড়া নেওয়া হয়েছিল। যদি অটো রিনিউ, অর্থাৎ আপনা-আপনি ভাড়ার মেয়াদ নবীকরণের ব্যবস্থা করা থাকে, তা হলে পূর্বনির্দিষ্ট কোনও অ্যাকাউন্ট থেকে ডোমেনের মালিক ভাড়ার টাকা কেটে নেবে। সারদার নিজস্ব সমস্ত ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট অবশ্য এখন অকেজো।
সল্টলেকের যে ওয়েব ডেভেলপার সংস্থা মারফত সুদীপ্তবাবু ইন্টারনেট ডোমেন ভাড়া করেছিলেন, তাদের তরফে কেউ এ প্রসঙ্গে মুখ খুলতে রাজি হননি। কিন্তু সাইটে এখনও আছেটা কী?
দেখা যাচ্ছে, সবই আছে। নির্মাণ, হোটেল, শিক্ষা, কৃষি থেকে শুরু করে শপিং মল, পর্যটন, মিডিয়া বা অর্থলগ্নি— সারদা গোষ্ঠীর যাবতীয় ব্যবসাক্ষেত্রের ফলাও বিবরণ সাইট জুড়ে। ‘ইভেন্ট’ অপশনে ক্লিক করলে জানা যাচ্ছে, বোলপুরে সারদা নতুন রিসর্ট খুলছে। উত্তরবঙ্গে হোটেল খোলা হয়েছে। সঙ্গে খান দশেক নতুন প্রকল্পের উল্লেখ, এমনকী, স্পেনের মাদ্রিদে নতুন শাখা খোলার পরিকল্পনাও। পাশাপাশি চাকরি-সংবাদ। সারদায় চাকরিপ্রার্থীদের ওয়েবসাইট মারফত আবেদন পেশের সুযোগ মজুত। নাম, ঠিকানা, ফোন নম্বর দিয়ে ফর্ম পূরণ করতে হবে। ফর্মে অবশ্য শিক্ষাগত যোগ্যতা উল্লেখের জায়গা নেই। কর্মপ্রার্থীদের উদ্দেশে সারদা-সাইটের প্রতিশ্রুতি, ‘আমাদের পছন্দ হলে আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করব।’
তদন্তকারীদের অনুমান, সম্ভবত এ ভাবে অর্থলগ্নি সংস্থায় ‘এজেন্ট’-ও নিয়োগ করা হতো। এখনও কেউ চাইলে সারদার সাইটে গিয়ে চাকরির ফর্ম ভরতে পারবেন। যদিও জমা দেওয়ার উপায় নেই।
এবং এই ওয়েবসাইটেই আছে মুখ্যমন্ত্রীর কথা। বিজ্ঞাপনে সারদার দাবি: ২০১১-র ২৯ নভেম্বর টাউন হলে এক অনুষ্ঠানে সংস্থার পত্রিকা উদ্বোধনের অনুষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় হাজির ছিলেন। গোষ্ঠীর ‘ব্র্যান্ড অ্যাম্বাস্যাডর’ হিসেবে বর্তমান তৃণমূল সাংসদ মিঠুন চক্রবর্তীর নাম রয়েছে। গায়ক তথা আসানসোলের বিজেপি প্রার্থী বাবুল সুপ্রিয়র নামও হাজির, সারদার এক অনুষ্ঠানে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করেছিলেন। সারদার মালিকানাধীন চারটে নতুন খবরের কাগজের কথা, একটি টিভি চ্যানেলে কুণাল ঘোষের অনুষ্ঠানের টিআরপি, নাট্যমেলা— এমন নানা তথ্যে এখনও সমৃদ্ধ সারদা গোষ্ঠীর ওয়েবসাইট।
সারদা-তদন্তে বিধাননগরের পুলিশ সারদা-কর্ণধার সুদীপ্ত সেনকে গ্রেফতার করেছে এক বছর হয়ে গেল। সিল করে দেওয়া হয়েছে গোষ্ঠীর যাবতীয় ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট ও ২৩৯টি অফিস। সারদার মিডিয়া সংস্থার সিইও তথা তৃণমূলের সাসপেন্ডেড সাংসদ কুণাল ঘোষ গ্রেফতার হয়েছেন, ধরা পড়েছেন সারদার আরও কিছু শীর্ষ কর্তা। ক্ষতিগ্রস্তদের স্বার্থে রাজ্য সরকার সারদা কমিশন গড়েছে। সম্প্রতি ইডি গ্রেফতার করেছে সুদীপ্তের প্রথম পক্ষের পুত্র ও দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রীকেও। উপরন্তু সারদায় সিবিআই হবে কি না, সুপ্রিম কোর্টে তার চূড়ান্ত ফয়সালা স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। যে সারদা ঘিরে এত দিন ধরে এত কিছু, রাজ্য-রাজনীতি তোলপাড়, তার পরেও তাদের ওয়েবসাইট চালু থাকাটা অস্বাভাবিক নয় কি?
পুলিশের মতে, অস্বাভাবিক কিছু নয়। “কেউ আমাদের কাছে অভিযোগ করলে হয়তো ওয়েবসাইট বন্ধ করার আর্জি জানানো যেত। কিন্তু আমরা নিজে থেকে কেন করতে যাব?”— পাল্টা প্রশ্ন ছুড়েছেন এক পুলিশ-কর্তা।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy