গত বছর রাজধানীর কুচকাওয়াজে পশ্চিমবঙ্গের ট্যাবলো।
নরেন্দ্র মোদী জমানার প্রথম বারের প্রজাতন্ত্র দিবসের অনুষ্ঠান। প্রধান অতিথি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা। তবে সেই অনুষ্ঠানে থাকছে না পশ্চিমবঙ্গ। আর ওয়াকিবহালরা এ জন্য মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের গোঁয়ার্তুমিকেই দায়ী করছেন।
মুখ্যমন্ত্রী এ বার পশ্চিমবঙ্গের ট্যাবলোয় তাঁর ঢাক-ঢোল পেটানো প্রকল্প ‘কন্যাশ্রী’-কে তুলে ধরতে প্রবল উৎসাহী ছিলেন। কিন্তু বাধ সেধেছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের বাছাই কমিটি। তাদের সাফ কথা, দেশের শিল্প ও সংস্কৃতির স্বকীয় বিষয়টি ট্যাবলোয় তুলে ধরাটাই রীতি। প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজকে রাজ্য সরকারের কোনও প্রকল্পের প্রচারের হাতিয়ার করাটা ঠিক নয়। বিষয়টি নিয়ে টানাপড়েনের পরে প্রতিরক্ষা দফতরের নিযুক্ত বাছাই কমিটি শেষ পর্যন্ত যে তালিকা তৈরি করেছে, পশ্চিমবঙ্গের নাম তাতে নেই।
অথচ রেলমন্ত্রী থাকার সময় থেকেই ২৬ জানুয়ারির প্যারেড নিয়ে মমতার বিশেষ উৎসাহ। রেল মন্ত্রকের ট্যাবলোয় তিনি রবীন্দ্রনাথের রেলযাত্রাকে ফুটিয়ে তুলেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরে পশ্চিমবঙ্গের ট্যাবলোয় রবীন্দ্রনাথের শান্তিনিকেতন ও স্বামী বিবেকানন্দকে তুলে ধরেন তিনি। বাছাই কমিটির সঙ্গে এ নিয়ে টক্করও হয়েছে মমতার। রবীন্দ্রনাথের ট্যাবলোর সঙ্গে ‘নীল দিগন্তে’রবীন্দ্রসঙ্গীত বাজবে বলে জেদ ধরেছিলেন তিনি। বাছাই কমিটি প্রথমে আপত্তি তুললেও শেষে তা মেনে নেয়। গত বার রাজ্যের ট্যাবলোর বিষয় ছিল পুরুলিয়ার ছৌ নাচ। রাজ্য এতে প্রথম পুরস্কার পায়।
দেশের সামরিক ক্ষমতা ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্রকে তুলে ধরাই প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজের প্রধান উদ্দেশ্য।ট্যাবলোর মাধ্যমে নিজস্ব সংস্কৃতির বিশেষ দিকগুলিকে তুলে ধরে বিভিন্ন রাজ্য। ২৬ জানুয়ারির কুচকাওয়াজে কার ট্যাবলো জায়গা পাবে, তা নিয়ে রাজ্যগুলির মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা হয়। বাছাইয়ের কাজটি করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কমিটি। এ বার মার্কিন প্রেসিডেন্ট থাকছেন বলে এই অনুষ্ঠান ঘিরে উদ্দীপনাও বেশি।
পশ্চিমবঙ্গের ট্যাবলো থাকছে না কেন এ বার?
সরকারি সূত্রে খবর, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে রাজ্য সরকার তাদের ‘কন্যাশ্রী’প্রকল্পটিই ট্যাবলোর মাধ্যমে তুলে ধরার প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের বাছাই কমিটি এমন বিষয় চায়, যার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজ্যটির শিল্প-সংস্কৃতির ভাবনা জুড়ে রয়েছে। তাঁদের বক্তব্য, ‘কন্যাশ্রী’ নিছক সরকারি উন্নয়ন প্রকল্প। খুব অভিনবও নয়। অনেক রাজ্যেই এই ধরনের প্রকল্প রয়েছে। মধ্যপ্রদেশের প্রকল্পটি এর চেয়ে অনেক বেশি আকর্ষণীয়। বাছাই কমিটির বক্তব্য, রাজ্যের সাংস্কৃতিক বৈচিত্রের বিষয়টি এই ‘কন্যাশ্রী’ থিমে প্রকাশ পায় না। তা ছাড়া প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের ট্যাবলোকে সরকারি প্রকল্প প্রচারের হাতিয়ার করাটাও অনুচিত। পর পর তিনটি বৈঠকে রাজ্যকে তাদের আপত্তির বিষয়টি বুঝিয়ে বিকল্প বিষয়-ভাবনা চাওয়া হয়। কিন্তু রাজ্য ‘কন্যাশ্রী’ নিয়ে অনড় মনোভাব নেয়। ফলে তিন বারের পর রাজ্যকে আর ডাকা হয়নি। তবে সরকারি ভাবে প্রস্তাব খারিজের বিষয়টি রাজ্যকে জানানোও হয়নি। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র দিল্লিতে প্রতিরক্ষা সচিব আর কে মাথুরকে চিঠি লিখে এ ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলেন। মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, রাজ্যের প্রস্তাব গৃহীত না হলে চিঠি লিখে জানানোর প্রথা নেই। বৈঠকে আর না ডাকার অর্থই হল সেই রাজ্যের প্রস্তাব বাতিল হয়েছে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের সূত্রের কথায়, ২৬ জানুয়ারির প্যারেডে সব রাজ্য জায়গা পায় না। এ বার কুচকাওয়াজে ২০টি ট্যাবলো থাকবে। নিরাপত্তা বাহিনীর বিভিন্ন শাখা, কেন্দ্রীয় নানা মন্ত্রকের ট্যাবলো ছাড়া মাত্র কয়েকটি রাজ্যের ট্যাবলোকেই বেছে নেওয়া হয়েছে।
কিন্তু কেন্দ্র আপত্তি করলেও রাজ্য সরকার কেন ট্যাবলোর থিম বদলালো না?
নবান্ন সূত্রে খবর, অন্য রাজ্য একাধিক থিমের প্রস্তাব বাছাই কমিটির কাছে জমা দিলেও মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গ সরকার একটিই থিম জমা দেয়। ‘কন্যাশ্রী’ নিয়ে মমতা এতটাই অনড় ছিলেন, তথ্য ও সংস্কৃতি দফতরের পরিবর্তে ট্যাবলো তৈরির দায়িত্ব এ বার দিয়েছিলেন নারী ও শিশু কল্যাণ দফতরের সচিব রোশনি সেনকে। প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের বিশেষজ্ঞ কমিটি যখন ‘কন্যাশ্রী’ নিয়ে আপত্তি তুলেছে, রাজ্য তখনও দ্বিতীয় কোনও প্রস্তাব জমা দেওয়ার বিষয়ে উৎসাহ দেখায়নি। নারী ও শিশু কল্যাণ দফতরের এক কর্তার কথায়, “আসলে মুখ্যমন্ত্রীর প্রস্তাবে যে আপত্তি উঠেছে, সেটা বোধ হয় তাঁকে জানানোর সাহসই কেউ দেখাতে পারেননি!”
সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কামান দাগছেন মমতা। জিএসটি-সহ একের পর এক কেন্দ্রীয় প্রস্তাবের বিরোধিতায় সংসদের ভিতরে-বাইরে সরব হয়েছে তৃণমূল। সে জন্যই কি বাতিল পশ্চিমবঙ্গের ট্যাবলো? প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের ব্যাখ্যা, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই বলে আসছেন প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত আর রাজনীতি এক নয়। এত মতভেদ সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় সড়ক পরিবহন মন্ত্রী নিতিন গডকড়ী নবান্নে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে সে রাজ্যের জাতীয় সড়কগুলির উন্নয়নে প্রস্তাব দিয়েছেন। সুতরাং এই অভিযোগ ঠিক নয়। তা ছাড়া শিল্প-সংস্কৃতি জগতের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়েই বাছাই কমিটি তৈরি করেছে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। পশ্চিমবঙ্গের প্রতিনিধিদের সঙ্গে তারা তিন বার বৈঠকে বসে। বিকল্প প্রস্তাব দিতেও বলে। কিন্তু রাজ্য কিছুই শুনতে চায়নি। অগত্যা সে রাজ্যের ট্যাবলো বাদ দিয়েই প্রজাতন্ত্র দিবসের কুচকাওয়াজ করার সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের ট্যাবলো-জটিলতা নতুন নয়। অটলবিহারী বাজপেয়ী সরকার পোখরানে পরমাণু বিস্ফোরণ ঘটানোর পরে রাজ্যের তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার ‘যুদ্ধ নয়, শান্তি চাই’ বার্তা দিয়ে ট্যাবলোর প্রস্তাব দেয়। তদানীন্তন তথ্য-সংস্কৃতি মন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সেই প্রস্তাব খারিজ করে প্রতিরক্ষা মন্ত্রক। ক্ষুব্ধ বুদ্ধদেব তার পর থেকে কখনও রাজধানীর কুচকাওয়াজে ট্যাবলো পাঠানোর প্রস্তাব দেননি। মমতা অবশ্য ক্ষমতায় আসার পরে তিন বছর ২৬ জানুয়ারির কুচকওয়াজে ট্যাবলো পাঠান। সেগুলি প্রশংসিতও হয়। নবান্নের অনেকে বলছেন, এ বার তাঁর একগুঁয়ে মনোভাবের জন্যই বাদ পড়ল রাজ্যের ট্যাবলো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy