আপাতত ঝাঁপ বন্ধ হয়ে গেল সারদা কমিশনের।
কমিশনের দ্বিতীয় দফার মেয়াদের শেষ দিন ছিল বুধবার। মেয়াদ আর বাড়ানো হচ্ছে কি না, জানতে এ দিন সকাল থেকেই উদগ্রীব ছিলেন কমিশনের কর্মী-অফিসারেরা। অপেক্ষায় ছিলেন রাজ্যের নানা অর্থলগ্নি সংস্থার আমানতকারী-এজেন্টরাও। কিন্তু রাত পর্যন্ত নবান্ন থেকে মেয়াদ বাড়ানোর বিষয়ে কোনও বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়নি। নবান্নের এক আধিকারিক জানান, মেয়াদ না বাড়ায় আপাতত বন্ধ হয়ে যাচ্ছে সারদা কমিশন। তবে কমিশনে থাকা নথিপত্র যাতে সুরক্ষিত থাকে, সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
নবান্ন সূত্রের খবর, কমিশনের সঙ্গে সরকারের যোগাযোগকারী অফিসার তথা আইজি (রেজিস্ট্রার অব বেঙ্গল) বিশ্বজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় এ দিন সন্ধ্যায় কমিশনে যান। তিনিও জানান, কমিশন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। তবে কমিশনে সরকারের যে সমস্ত কর্মী রয়েছেন, তাঁরা সোমবার থেকে ওই অফিসেই বসবেন। সব নথিপত্র সরকারের হাতে না যাওয়া পর্যন্ত সেখানেই থাকবেন। কমিশনে সরকারের যে টাকা জমা রয়েছে, তা ফিরিয়ে দেওয়ার কাজও করবেন তাঁরা। কমিশনে প্রায় ৪৫ জন কর্মী-অফিসার রয়েছেন। এঁদের মধ্যে ২৫ জন অবসরপ্রাপ্ত। অন্যরা বিভিন্ন দফতর থেকে ডেপুটেশনে এসেছেন।
কমিশন সূত্রের খবর, এ দিন বিকেল থেকে রিপোর্ট লেখা শুরু করেছিলেন চেয়ারম্যান শ্যামলকুমার সেন। রাত পৌনে দশটা পর্যন্ত সেই কাজ চলে। তার পরেই চেয়ারম্যান কমিশনের অফিস থেকে বেরোন। তবে রিপোর্ট তৈরি হলেও সরকারি দফতর বন্ধ থাকায় সোমবারের আগে তা পাঠানো হচ্ছে না।
কমিশন সূত্রের খবর, ২০১৩ সালের ২৩ এপ্রিল কমিশন চালু হওয়ার পর টাকা ফেরত চেয়ে মোট সাড়ে ১৭ লক্ষ আবেদনপত্র জমা পড়ে। এর মধ্যে সাড়ে ১২ লক্ষ আমানতকারী সারদার। প্রথমে তাঁদেরই টাকা ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় কমিশন। রাজ্য সরকার এ বাবদ ২৮৬ কোটি টাকা কমিশনকে দেয়। এর মধ্যে পাঁচ দফায় ৪ লক্ষ ৯৮ হাজার ৩৪৫টি চেক পাঠায় কমিশন। মোট টাকার পরিমাণ ২৫১ কোটি ২২ লক্ষ। বাকি প্রায় ৩৫ কোটি টাকা কমিশনে রয়েছে। উপরন্তু লোকসভা নির্বাচনের সময় নির্বাচনী বিধির কারণে প্রায় ১০৩ কোটি টাকার চেক বিলি করা যায়নি। মেয়াদ পার হয়ে যাওয়া সেই সব চেক ফেরত আসে। তারিখ বদল করে ফের তা আমানতকারীদের হাতে পাঠানোর কথা। সেটা এখনও হয়ে ওঠেনি। ফলে ওই টাকাও কমিশনের অ্যাকাউন্টে রয়েছে।
অর্থাৎ সরকারের দেওয়া ২৮৬ কোটির মধ্যে প্রায় ১৩৭ কোটি ৭৮ লক্ষ টাকা স্টেট ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়ার সমৃদ্ধি ভবনের শাখায় জমা রয়েছে বলে কমিশন সূত্রে খবর। এ ছাড়া কমিশন সারদার সম্পত্তি বিক্রি করে প্রায় ২ কোটি ৩৯ লক্ষ টাকা আদায় করেছিল। সে টাকাও কমিশনের অ্যাকাউন্টে জমা রয়েছে। অর্থাৎ কমিশনের তহবিলে মোট জমা রয়েছে ১৪০ কোটি ১৭ লক্ষ টাকা। এই টাকা ফিরিয়ে দেওয়া হবে সরকারের কাছে।
কমিশনের মেয়াদ আর বাড়ানো হবে কি না তা নিয়ে গত কয়েক দিন ধরেই টালবাহানা চলছিল। কারণ ক্ষতিগ্রস্ত অনেকেই এখনও টাকা পাননি। সেই সঙ্গে সারদা ছাড়া অন্য গোষ্ঠীর ক্ষতিগ্রস্তরাও যাতে টাকা ফেরত পান, তা নিয়েও শুনানি চলছিল কমিশনে। স্বভাবতই কর্মীরা-সহ আমানতকারীদের একটি বড় অংশ ধরে নিয়েছিলেন কমিশনের মেয়াদ বাড়ানো হবে। কিন্তু তা না হওয়ায় এজেন্ট ও আমানতকারীরা ক্ষুব্ধ। এ দিন সকাল থেকে তাঁদের অনেকেই ভিড় করেছিলেন কমিশনে। সুন্দরবন থেকে আসা জনৈক অর্চনা দাস যেমন বেলা চারটে নাগাদ একটি আবেদন নিয়ে হাজির। কমিশনের এক কর্মী তাঁকে বললেন, ‘‘এখানে দিয়ে আর লাভ নেই। নবান্নে যান!’’ সেই সময়েই কমিশনের এক কর্মী এসে জানালেন, ‘‘জিপিও থেকে তিন বস্তা আবেদনপত্র এসেছে।’’ উত্তর এল, “রেখে দাও।”
এ দিন তিন সদস্যের মধ্যে শুধু শ্যামলবাবুই হাজির ছিলেন। যোগেশ চট্টোপাধ্যায় ছুটিতে। অম্লান বসু আসেননি। অসুস্থতার কারণে আসতে পারেননি সচিব মিহির ভট্টাচার্যও।
কমিশনে শেষ দিনেও নিয়মমাফিক হাজির করানো হয়েছিল সুদীপ্ত সেনকে। তাঁর একটি পিটিশনের সূত্রে সিবিআই, ইডি এবং সিট-কে ডেকে পাঠিয়েছিল কমিশন। পিটিশনে সুদীপ্ত বলেছিলেন, যে ‘সাফারি সফটওয়্যার’ দিয়ে আমানতকারীদের তালিকা করা হয়েছে, তাতে ভুল তথ্য রয়েছে। বর্তমানে ওই সফটওয়্যার সিবিআইয়ের হাতে। দিন কয়েক আগেই কমিশন ওই তিন সংস্থার প্রতিনিধিদের ডেকেছিল। কিন্তু সিবিআই তখন আসতে পারবে না বলে জানিয়েছিল। এ দিন তাই ফের তাঁদের ডাকা হয়। এ ছাড়াও এ দিন প্রয়াগ, আইকোর, এমপিএস-সহ ২২টি সংস্থার বিষয়ে শুনানি হয়।
সেন কমিশন নিয়ে এ দিন বিরোধী দলগুলি অবশ্য সরকারের সমালোচনা চালিয়েই গিয়েছে। বিরোধী দলনেতা সূর্যকান্ত মিশ্র মঙ্গলবারই বলেছিলেন, অপরাধীদের আড়াল করতে যে এই কমিশন গড়া হয়, তা আগেই প্রমাণিত। নবান্ন অভিযানে গিয়ে প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি অধীর চৌধুরীরও এ দিন অভিযোগ, “মমতার দলের লোকেরা যে কোটি কোটি টাকা লুঠ করেছে, তাকে বাঁচাতে চেয়েছে এই কমিশন।” আবার বিজেপি-র দাবি, “কমিশনের তথ্যের সঙ্গে সরকারি তথ্যের সাযুজ্য নেই। মুখ্যমন্ত্রী মনগড়া পরিসংখ্যান দিয়ে মানুষকে ভুল বোঝানোর প্রবণতা অব্যাহত রেখেছেন।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy