কাজ চলছে শহরের একটি কামারশালায় (বাঁ দিকে), দোকানের সামনে সাজানো পসরা (ডান দিকে)। রামপ্রসাদ সাউয়ের তোলা ছবি।
“দাঁতনেতে লোহার জাঁতি, পানে মোহনপুর/ ও ভাই জেলা মেদিনীপুর।”
১৯৬৩ সালে হিন্দুস্থান রেকর্ডের গ্রামোফোনে মেদিনীপুরের লোকগীতি শিল্পী সত্যেন মোহান্তি-র এই গানই বলে দেয় দাঁতনের কুটির শিল্প আজও বেঁচে রয়েছে কাকে ঘিরে।
বরাবর দাঁতনের অর্থনীতি কৃষির ওপর নির্ভরশীল ছিল। তবে প্রাচীন অনেক কুটির শিল্প ছিল এই শহরে। যার মধ্যে সবথেকে নামডাক ছিল শহরের কামার শিল্পের। এক সময় রাজ্য জুড়ে প্রসিদ্ধ ছিল দাঁতনের জাঁতি, বটি, কাটারির মতো যন্ত্রপাতি। ঐতিহ্যবাহী এই শিল্প আজও টিকে রয়েছে।
দাঁতনের বাণিজ্যিক গুরুত্ব বেড়েছিল কৃষিকে নির্ভর করে। এখনও পর্যন্ত সুবর্ণরেখা ঘেঁষা শহরের পশ্চিমাংশে সব্জি চাষ ও পূর্বাংশে ধান চাষে রমরমা রয়েছে। যদিও এক সময়ে দেশি পান উৎপাদনে দাঁতন ছিল এগিয়ে। এখন সেই জায়গাটা নিয়ে নিয়েছে মোহনপুর। উৎপাদিত পান ভিন রাজ্যে নিয়ে যাওয়ার জন্য একসময় এই এলাকায় বাঁশের ঝুড়ির শিল্পের রমরমা ছিল। এখনও শহরের অদূরে মনোহরপুর ও শালিকোটা গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায় এই শিল্প যুক্ত বেশ কিছু পরিবারকে দেখতে পাওয়া যায়। এই শিল্পের পিছনে দাঁতনের অধিকাংশ গ্রামে প্রচুর বাঁশঝাড় একটি বড় কারণ। এখন সেই ঝুড়ির ব্যবহারও কমেছে। ফলে মন্দার মুখে ঝুড়ি শিল্পও।
তবে এখনও শহরের বুকে চলতে থাকা দাঁতনের ঐতিহ্যবাহী কামার শিল্পের খ্যাতি রাজ্য জুড়ে। পুরনো ওড়িশা ট্রাঙ্ক রোডের ধারে স্কুলবাজার এলাকার ‘রাণা’ পরিবার এখনও এই পেশার সঙ্গেই যুক্ত। হঠাৎ জাঁতির তৈরির এমন রমরমা কেন?
অনেকেই বলেন, একদিকে চাষের রমরমা ও পানের উৎপাদের সঙ্গে এলাকাবাসীর মধ্যে পান খাওয়ার প্রবণতা ছিল এই শিল্পের উৎপত্তির মূলে। কারণ পানের সুপুরি কাটার জন্য জাঁতির প্রয়োজনীয়তা ছিল। তাছাড়া কৃষিজ পণ্য কাটার জন্য কাটারি, কাস্তে ও বঁটির চাহিদা বাড়ছিল।
এখনও ওই সরঞ্জামের মান বজায় রাখতে মান্ধাতার আমলের হাঁপর, হাতে ঘোরানো শান মেশিন, ছেনি-হাতুড়ি দিয়ে চলছে এই শিল্প। কিছু বাড়িতে এসেছে বিদ্যুৎ চালিত শান মেশিন। আগুনে ইস্পাত লোহা গরম করে পিটিয়ে পাতলা করে ধার দেওয়ার কাজে পরিশ্রম রয়েছে অমানবিক। তবে পরিশ্রম অনুযায়ী পারিশ্রমিক পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ কামার পরিবারগুলির। তাই পরিশ্রমের কথা চিন্তা ও সরকারি উৎসাহ না পেয়ে নতুন প্রজন্ম শিল্পে আগ্রহ হারাচ্ছে বলে অভিযোগ কামারদের।
যেমন তারাপদ রাণা বলছিলেন, “আমার দুই ছেলের এক ছেলে স্কুল শিক্ষক ও একজন সোনার দোকানে কাজ করছে। তাছাড়া কোনও সরকারি অনুদান না থাকায় উৎসাহ পাবে কীভাবে? কিন্তু আমরা চাই এই ঐতিহ্য বেঁচে থাকুক।” অন্য দিকে এখন বেড়েছে এই কুটির শিল্পের কাঁচামাল ইস্পাত লোহার দরও। ফলে মুনাফা না পেলেও লড়াই চালাচ্ছে পরিবারগুলি।
যদিও দাঁতন শহরের ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত এই শিল্প চিরকাল বেঁচে থাকুক এমনটাই চাইছেন স্থানীয় বাসিন্দারাও। তাঁদের দাবি, উন্নত পরিকাঠামোযুক্ত বাজারে সরকারে পক্ষ থেকে এই কামার শিল্পকে তুলে ধরা হোক। স্থানীয় একটি ক্ষুদ্র পত্রিকার সম্পাদক প্রবীন অতনুনন্দন মাইতির কথায়, “স্থানীয় বহু পত্রিকায় এই কামার শিল্পকে তুলে ধরা হয়েছে। এই শিল্পকে বাঁচাতে সরকারি উদ্যোগে উৎপাদিত সরঞ্জামের নির্দিষ্ট বাজার করা ও জেলার বিভিন্ন প্রদশর্নীতে স্থান দেওয়া মনে হয়।’’
স্থানীয় পঞ্চায়েত সমিতির সভাপতি অঞ্জলি বারির কথায়, ‘‘কুটির শিল্পের জন্য অনেক কিছু করার পরিকল্পনা রয়েছে। আমরা প্রস্তাব পেলে নিশ্চয় এই ঐতিহ্যবাহী কামার শিল্পকে নির্দিষ্ট স্থানে স্টল করে বসানো যায় সেটা ভাবব।”
এলাকার বিধায়ক বিরাম মাণ্ডি বলেন, “বছর কুড়ি আগে বাম সরকার সমস্ত কুটির শিল্পীদের পরিচয়পত্র দিয়েছিলেন। তাই দাঁতনের এই ঐতিহ্যবাহী কামার শিল্পকে নিয়ে যাতে বর্তমান সরকার কিছু ভাবনাচিন্তা করে তার জন্য উদ্যোগ নেব।”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy