শুক্রবার বিকেল। ঘড়ির কাঁটা চারটে ছোঁয়নি। রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠক শেষের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঘরে সবেমাত্র শুরু হয়েছে শিল্প-পরিকাঠামো বিষয়ক মন্ত্রিগোষ্ঠীর বৈঠক। হঠাৎ মেসেজটা এল পঞ্চায়েতমন্ত্রী সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের মোবাইলে ‘মদন মিত্র গ্রেফতার’।
সহকর্মীদের জিজ্ঞেস করেন সুব্রতবাবু, “মদনের কী হল?” সকলে বলেন, “সিবিআই-তে গিয়েছে।” কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেজে ওঠে ফিরহাদ হাকিমের মোবাইল। দেখা যায়, ভুরু কুঁচকে ফিরহাদ বলছেন, “তাই নাকি, কখন?” ফোন রেখে ফিরহাদ বোমাটা ফাটান, “মদনদা’কে গ্রেফতার করেছে সিবিআই।” মুহূর্তের মধ্যে একই বার্তা ঢুকে পড়ে মুখ্যমন্ত্রীর মোবাইলে। তবু নিশ্চিত হতে দিনভর লোকচক্ষুর আড়ালে থাকা তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদককে একটা ফোন করেন নেত্রী। এবং তিনি, মুকুল রায়ও জানান, খবর সত্যি!
চিৎকার করে ওঠেন রাজ্যের প্রশাসক “গেল আর ধরে নিল!” মুখ্যমন্ত্রীর মুড বুঝে মাঝপথেই ভন্ডুল হয়ে যায় বৈঠক। তার পর থেকে ঘণ্টা দেড়েক ধরে কার্যত নজিরবিহীন এক নাটক দেখে নবান্নের ১৪ তলা।
পরিবহণমন্ত্রী গ্রেফতারের খবর শুনে মুখ্যমন্ত্রী প্রথমেই বলেন, “এটা হতে পারে না। আগে আমাদের জানাতে হবে। স্পিকারের অনুমতি নিতে হবে। কোনও সৌজন্য নেই? আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয়। তাই এই গ্রেফতার বেআইনি।” সূত্রের খবর, উপস্থিত মন্ত্রীদের কাছে মুখ্যমন্ত্রী জানতে চান, তিনি কিছু ভুল বলছেন কি না? সুব্রতবাবু, ফিরহাদ, পার্থ চট্টোপাধ্যায়রা জানান, নেত্রী যা বলছেন, সব ঠিক। এ ভাবে সিবিআই গ্রেফতার করতে পারে না। অবশ্য এঁদেরই এক জন শনিবার বললেন, “যা পরিস্থিতি ছিল, তাতে মুখ্যমন্ত্রীর তালে তাল দিতেই হতো। অন্য কথা বললে পুলিশ ডেকে ১৪ তলা থেকে গঙ্গার জলে ছুড়ে দিলেও অবাক হওয়ার কিছু ছিল না।”
তিনি যে ‘ঠিক’ বলছেন, তা যাচাই করতে কিছুক্ষণের মধ্যেই মুখ্যমন্ত্রী ঘরে ডেকে পাঠান মুখ্যসচিব সঞ্জয় মিত্র এবং রাজ্য পুলিশের ডিজি জিএমপি রেড্ডিকে। এবং তাঁদেরও জানান, এ ভাবে সিবিআই কোনও রাজ্যের মন্ত্রীকে গ্রেফতার করতে পারে না। কারণ, আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয়। রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করেই যা করার করতে হবে। মুখ্যসচিব এই সময়ে আইনের বই ঘেঁটে বলেন, “ম্যাডাম, আদালতের নির্দেশে সিবিআই তদন্ত চলছে। সিবিআই কাউকে গ্রেফতার করতে চাইলে রাজ্যের সঙ্গে আলোচনা করার আইনি বাধ্যবাধকতা নেই। নিয়ম অনুযায়ী, ওরা স্পিকারকে চিঠি দিয়ে গ্রেফতারির কথা জানালেই হল। আইনসভা থেকে গ্রেফতার করতে হলে তখনই স্পিকারকে জানানোর প্রসঙ্গ আসে।” মুখ্যসচিবের কথায় সম্মতি জানান ডিজি। তিনি যা চাইছেন, আইনে তা লেখা নেই দেখে আরও চটে যান মুখ্যমন্ত্রী। এক অফিসারকে নির্দেশ দেন, স্পিকার বিমান বন্দ্যোপাধ্যায়কে ফোনে ধরতে। স্পিকারকে মুখ্যমন্ত্রী জিজ্ঞেস করেন, “আপনাকে সিবিআই কিছু জানিয়েছে? আপনার অনুমতি ছাড়া কী ভাবে গ্রেফতার করল ওরা? এক্ষুনি আইন-কানুন পড়ে আমায় জানান।” উপস্থিত এক মন্ত্রীর কথায়, “বুঝলাম স্পিকারও মুখ্যমন্ত্রীর কথা মেনে আইনের বই পড়ে মতামত দেওয়ার কথা জানালেন।” কিন্তু তিনি যে ভাবে ভাবছেন সে রকম কিছু আইনে কেন নেই, তা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী দু’কথা শোনান মুখ্যসচিব এবং ডিজিকে। ওঁরা তখন চুপ করে বসে ছিলেন মুখ্যমন্ত্রীর উল্টো দিকে। সেই সময় ঘরে থাকা এক আমলার কথায়, মুখ্যসচিব-ডিজিকে দেখে কষ্ট হচ্ছিল। মনে হচ্ছিল, ফৌজদারি বিধি-সংবিধান-আইনসভার নিয়ম-কানুন তাঁরা নিজেরাই যদি বদলে দিতে পারতেন, তা হলে মুখ্যমন্ত্রীর মুড ফেরাতে তা-ই করতেন।
মুখ্যমন্ত্রী অবশ্য কারও উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে আইন বদল নিয়ে নিজেই খোঁজখবর শুরু করেন। তাঁর সচিবালয় থেকে ফোন যায় আইন ও বিচার সচিবের কাছে। মুখ্যমন্ত্রী তাঁকে নির্দেশ দেন, “সিবিআই যাতে রাজ্যকে এড়িয়ে আর কাউকে গ্রেফতার করতে না পারে সে জন্য আইন বদলান।” নিরুপায় আইনসচিব নাকি মুখ্যমন্ত্রীকে জানান, আইনমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে নিশ্চয়ই একটা পথ বের করবেন তিনি। ঘরে তখন পিন পড়লেও শব্দ হবে।
সত্যিই কি এমন কিছু করা সম্ভব? আইন দফতরের এক কর্তার কথায়, “আইন-শৃঙ্খলা রাজ্যের বিষয় বলে যে কোনও গ্রেফতারই রাজ্যকে জানিয়ে করতে হবে বলে মনে করেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু কিছুতেই তাঁকে বোঝানো যাচ্ছে না, রাজ্য পুলিশের তদন্তাধীন আরাবুল-অনুব্রতদের ব্যাপারটা এক রকম, আর সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশে সিবিআইয়ের তদন্তের বিষয়টি অন্য রকম। তারা আগে থেকে কিছু জানাতে বাধ্য নয়।”
কোনও দিক থেকে ইতিবাচক সাড়া না পেয়ে মরিয়া ও ক্রুদ্ধ মুখ্যমন্ত্রী তখন পারলে সিবিআই-কেই অস্বীকার করতে চলেছেন। তাঁর একটাই কথা, এ সব নরেন্দ্র মোদী-অমিত শাহের ষড়যন্ত্র। দিল্লিতে বিজেপি নেতৃত্বের কানে তাঁর এই রণং দেহি বার্তা যাতে ঠিকমতো পৌঁছোয়, সে ব্যবস্থা করেন মুখ্যমন্ত্রী। রাজধানীর কয়েক জন বুদ্ধিজীবীকে ফোন করে বলেন, “অন্য রাজ্য সফরে বেরোচ্ছি। সব ফাঁস করব। আমি জয়ললিতা নই যে চুপ করে যাব। দিল্লিতে গিয়ে বসে পড়ব।” সাংবাদিক সম্মেলন করে মোদী-অমিতের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দেবেন বলেও ঠিক করেন মুখ্যমন্ত্রী। কিন্তু অন্য মন্ত্রীরা তাতে বাদ সাধেন। মুকুল রায় টেলিফোনে তাঁকে বোঝান, সাংবাদিক বৈঠকে এ সব বলা ঠিক হবে না। তখনকার মতো ১৪ তলায় সাংবাদিক বৈঠকের পরিকল্পনা বাতিল হয়ে যায়। সুব্রতবাবু, পার্থবাবু এবং ফিরহাদ হাকিমকে নবান্নের প্রেস কর্নারে পাঠিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে তোপ দাগান মুখ্যমন্ত্রী।
এক মন্ত্রী জানালেন, এর পরেও শান্তি পাচ্ছিলেন না মুখ্যমন্ত্রী। ছটফট করছিলেন। সেই সময় ভাই কার্তিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ফোন আসে। ভাইয়ের আর্তি, গোষ্ঠ পালের মূর্তির সামনে থেকে মদন মিত্রের সমর্থনে ডাকা শনিবারের মিছিলের সময়টা যদি একটু বদলে দেওয়া যায়। কারণ, প্রায় একই সময়ে তাঁরও একটি অনুষ্ঠান রয়েছে ধর্মতলা চত্বরে। বলা মাত্রই মুখঝামটা খান সহোদর। তার পর চলে মোদী ও অমিত শাহকে লক্ষ করে নানা মুদ্রাবিশিষ্ট বিষোদ্গার। কখনও সহারার লাল ডায়েরি তো কখনও প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রীর প্রসঙ্গ। কখনও সংবাদমাধ্যমের আদ্যশ্রাদ্ধ, কখনও অমিত শাহের কারাবাস প্রসঙ্গ। তার মাঝেই বলে বসেন, “আমি ‘প্রেস’ করে সবাইকে নাঙ্গা করে দেব।” সুব্রতবাবু নাকি তাতে তাল দেন, “তোর দু’কথা আজকের দিনে বলা উচিত। তা হলে দলের নিচুতলা পর্যন্ত বার্তাটা যাবে। আমার কথা তো অতটা নীচে নামবে না।”
আর থামানো যায়নি মুখ্যমন্ত্রীকে। প্রবীণ মন্ত্রীর পরামর্শে লিফ্টে নীচে নেমে আসেন। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে ঘোষণা, “তোরা, সরি তোমরা, সরি আপনারা পারলে আমাকে গ্রেফতার করুন। দেখি কার কত ক্ষমতা!”
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy