বর্ষীয়ান: হেড হান্টারদের একজন
লেডি রাইডারদের সংখ্যা বাড়ছে। আমিও মাঝে ভেবেছিলাম, একটা বাইক কিনে নেব। কিন্তু স্কুটিটা এখন আমার আইডেন্টিটি হয়ে গিয়েছে। স্কুটি নিয়েই অন্নপূর্ণা সার্কিট রাইড করে এলাম সদ্য। সম্ভবত এই প্রথম কোনও ভারতীয় মেয়ে স্কুটিতে এই সার্কিট কমপ্লিট করল। জীবনের প্রথম রাইড ছিল লাদাখ, কার্ফুর মধ্যেই চলে গিয়েছিলাম। আমার আবার উচ্চতা কম বলে স্কুটির দু’দিকে পা-ও পৌঁছয় না! যত দুর্গম পাহাড়েই যাই, আমার এ ক’বছরের রাইড অ্যাডভেঞ্চারে গভীর ছাপ ফেলে গিয়েছে নাগাল্যান্ড। বিশেষ করে, সেখানকার হেড হান্টারদের গ্রামে যাওয়ার অভিজ্ঞতা।
২০১৮ সালের বর্ষায় নর্থ-ইস্টে রাইডের প্ল্যান করেছিলাম। ইচ্ছে করেই জুন-জুলাইয়ের সময়টা বেছেছিলাম, অফ রোডিং করব বলে। সাধারণত আমি সোলো রাইড করি। সে বার সেমেস্টারের শেষে সেভেন সিস্টার্সের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়েছিলাম আমি আর আমার বন্ধু।
অসম, মণিপুর, মিজ়োরাম হয়ে শেষ গন্তব্য ছিল নাগাল্যান্ড। ঠিক করে রেখেছিলাম, মন গ্রামে যাব। সেখান থেকেই লুঙ্গওয়া, যেখানে এখনও কয়েক ঘর হেড হান্টার থাকেন। ডিসকভারি চ্যানেলে দেখে আগে থেকেই ছক কষে রেখেছিলাম, রুটম্যাপে লুঙ্গওয়া থাকবেই। ওখানে নেটওয়র্ক কাজ করে না, তাই হ্যান্ড ম্যাপই ভরসা। কোথাও রাস্তাই নেই, মাথা ছাড়িয়ে যাওয়া লম্বা লম্বা ঘাস শুধু! স্থানীয় ভাষা বোঝা মুশকিল। ফলে পথ বাতলে দেবে কেউ, সে উপায়ও বন্ধ। উত্তর-পূর্ব ভারতের নানা জায়গায় শিস দিয়ে ডাকার চল আছে। ত্রিপুরার ছবিমুরাতেও একই জিনিস দেখেছিলাম।
সাধারণত সন্ধে সাতটার পরে স্কুটি চালাই না আমি। অসম হয়ে যেতে হয় লুঙ্গওয়ার দিকে, পৌঁছে গেলাম সময় মতোই। সেখানকার রাইডিং গ্রুপের সদস্যরা আমাদের স্বাগত জানাতে এসেছিলেন। তাঁদেরই একজন ঠোঙাভর্তি সিল্ক ওয়র্ম মুখের সামনে ধরে বললেন, ‘হ্যাভ সাম!’ আমার হাঁ হয়ে যাওয়া মুখের সামনেই টুথপিকে তুলে টপাটপ নিজের মুখে পুরতে লাগলেন! হোটেলে খেতে গিয়ে রাইস উইথ ডগ মিট ১৬০ টাকা প্লেট দেখেই পোষ্যর মুখটা ভেসে উঠল। স্থানীয় বাজারে মাংস বলতে পাওয়া যায় সাপ, ব্যাঙ, ছোট কুমির, ইঁদুর, কুকুর, শূকর। বাকি দিনগুলো তাই ডাল-ভাত-স্যালাড খেয়ে কাটিয়ে দিলাম।
হেড হান্টারদের গ্রামটা একেবারে ভারত-মায়ানমার সীমান্তে। জেনে গিয়েছিলাম, যে গেস্ট হাউসে আমাদের থাকার কথা, তার মাথায় হর্নবিলের মূর্তি। খুঁজতে গিয়ে দেখি, প্রায় সব বাড়ির মাথাতেই রয়েছে হর্নবিল! শেষমেশ খুঁজে পাই। তার কয়েকশো মিটারের মধ্যেই আর্মি ক্যাম্প। জওয়ানরা কেউ রাজস্থানের, কেউ উত্তর প্রদেশের। বেশিরভাগই নিরামিষাশী, তাই এখানে খাওয়াদাওয়ার বেজায় অসুবিধে। একমাত্র ক্যাম্পেই জেনারেটর রয়েছে। বাকি গ্রামটা সূর্য ডোবার পরেই অন্ধকারে ডুবে গেল ঝুপ করে।
সীমান্তের কড়াকড়ি নেই মন-এ। গ্রামে হেড হান্টারদের প্রধানের বাড়ির মধ্য দিয়েই গিয়েছে কাঁটাতার। দু’দিকেই চলে রাজার নিয়ম। কোন্যাক জনজাতি হেড হান্টার বলেই বাইরের দুনিয়ায় পরিচিত। কোনও চ্যানেল থেকে এসেছি কি না, ছবি তুলব কি না ইত্যাদি প্রশ্নের সদুত্তর পেয়ে তবেই ঢোকার অনুমতি মিলল। স্বাগত জানালেন গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষটি। বয়সের কোঠা একশো ছাড়িয়েছে। একমুখ হাসি দেখে ভুলে গেলাম, এঁরাই এক সময়ের দুর্ধর্ষ নরশিকারী! পরনে একটা চেন তোলা জ্যাকেট আর হাফ প্যান্ট। সরকার থেকে যেমনটা পরিয়ে দেওয়া হয়েছে, তেমনটাই পরে রয়েছেন। বাড়িতে কোনও আয়না নেই। রান্নাঘর আর শোয়ার ঘরের মাঝখান দিয়ে গিয়েছে ভারত-মায়ানমারের সীমারেখা।
দলে-দলে গ্রাম দখলের লড়াই, ধড় থেকে আলাদা করে দেওয়া প্রতিপক্ষের মুন্ডু, বিজয়চিহ্ন হিসেবে শিকারের সংখ্যা অনুযায়ী সারা শরীরে আঁকা উল্কি— হেড হান্টারদের পরিচয় বলতে এটাই। শত্রুর মাথা আর পা প্রথমেই কেটে ফেলা ছিল দস্তুর। মানুষ শিকার অনেক দিনই বন্ধ হয়েছে বটে, তবে জীবনযাত্রার বাকি দিকগুলো আগের মতোই রয়ে গিয়েছে ভূমিপুত্রদের। গোটা গ্রামে সর্বকনিষ্ঠ হেড হান্টারের বয়স ৬৭। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার মুখে দাঁড়িয়ে সেই জনজাতির জনা তিরিশেক প্রতিনিধি।নর্থ ইস্টের বেশির ভাগ জায়গার মতোই হেড হান্টারদের গ্রামও কার্যত নারীতান্ত্রিক। পরিবারের পুরুষ সদস্যরা বসে বসেই কাটিয়ে দেন সারা দিন। সকাল থেকে মহিলারা খাবারের খোঁজে বেরোন, রান্নাও তাঁরাই করেন। বেশির ভাগ দিনই মেনুতে জংলি শাকপাতা আর মেঠো ইঁদুর জাতীয় প্রাণী। রান্নার পদ্ধতিও সহজ, পুরোটাই ভাপানো হয় ধাপে ধাপে। আদি অকৃত্রিম জীবনচর্যার প্রকৃষ্ট উদাহরণ রান্নাঘরটি। সারা বাড়ির বিভিন্ন দেওয়ালে শিকার ও অস্ত্রের প্রদর্শন। কথাবার্তা চলছিল স্থানীয় মিডিয়েটরের মাধ্যমে। বুঝলাম, ওঁরা চান, ওঁদের ব্যাপারে আরও জানুক বাইরের দুনিয়া। ফিরে আসার আগে ওঁরা আকারে ইঙ্গিতে আমাদের তোলা ছবিগুলো দেখতে চাইলেন। ঠিক করলাম, ফের কোনও দিন গেলে অবশ্যই বাঁধিয়ে নিয়ে যাব ফ্রেমগুলো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy