ধূসর: সমুদ্রের তীরে
নগরের কোলাহল থেকে দূরে নিরিবিলি সমুদ্রতট ওড়িশার জলেশ্বরে। লাল কাঁকড়া ও পাখির সিম্ফনি চন্দ্রাবলির মূল আকর্ষণ। লিখছেন ঈপ্সিতা বসু
এখানে শুধু সমুদ্র আপনার সঙ্গে কথা বলবে। ওড়িশা ও বাংলার সীমান্ত বরাবর বালাসোর জেলার চন্দ্রাবলি সমুদ্রসৈকত, ঠিকানাটা এখনও বেশি পরিচিত নয়। জলেশ্বর শহর থেকে প্রায় ৪৮ কিলোমিটার দূরে, (দিঘা থেকেও প্রায় একই দূরত্ব) চন্দ্রাবলি ওড়িশার অনাঘ্রাতা সমুদ্রসৈকতের মধ্যে অন্যতম। প্রকৃতির কোলে দুটো দিন কাটাতে জলেশ্বর পৌঁছলাম আমরা। আগে থেকেই বলে রাখা ছিল গাড়ি। জলেশ্বর পৌঁছতেই সেই গাড়ি এসে গেল আমাদের নিতে। চন্দনেশ্বর সড়ক ধরে এগিয়ে চললাম। রাস্তার দু’পাশে আনাজের খেত। কিছু দূর এগোতেই সুবর্ণরেখার কয়েক ঝলক, তার পর কীর্তনিয়া দিয়ে সোজা এগোতেই চন্দ্রাবলি। এখনও এখানে সে ভাবে ভিড় জমেনি ভ্রমণপিপাসুদের।
থাকার জন্য আছে অল্প কিছু হোমস্টে। অবশ্যই আগে থেকে বুক করে যাবেন। ওখানে গিয়ে ঘর না-ও পেতে পারেন। ঘরোয়া খাবার পাওয়া যায়। ওড়িশার মানুষদের রান্নার সুখ্যাতি রয়েছে, সেই স্বাদ পাবেন আহারে। নাগরিক কোলাহল থেকে দূরে সময় কাটানোর উদ্দেশে দু’দিন জমিয়ে বসলাম এমন ঘরোয়া পরিবেশে। সকালে ঘুম ভাঙে পাখির ডাকে আর মাছ ধরা নৌকার আনাগোনায়। প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়তেই তট জুড়ে লাজুক লাল কাঁকড়ার বালি দিয়ে গড়া ছন্দোবদ্ধ আলপনায় চোখ আটকায়। সামনে দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্র। সমুদ্রস্নানের উদ্দামতা নেই। আছে শুধু পাখির ডাকের সিম্ফনি, পাতা ঝরার মৃদু আওয়াজ, সমুদ্রের নিষ্পাপ সফেদ ঢেউ আর গাছগাছালির বুনো ঝিমধরানো গন্ধ।
সাদা বালি আর পাথুরে রাস্তা বেয়ে, ঝাউবনের আঁচল সরিয়ে আরও এগোলে চোখে পড়ে এক অচেনা দৃশ্য। দূরে সুবর্ণরেখা সাগরে পড়েছে। ভাঙা পাড় অদ্ভুত জ্যামিতিক নকশা এঁকেছে। স্থানীয় কিছু মানুষের দেখা মিলল সেখানে। তাঁরা সমুদ্র থেকে তুলে আনছেন ঝিনুক। চারিদিকে স্তূপীকৃত ঝিনুকের এই দৃশ্য দেখে কৌতূহল বাড়ল। তাঁদের কাছ থেকে জানলাম, সমুদ্র থেকে বয়ে আনা এমন অজস্র ঝিনুকের ঝাড়াইবাছাইয়ের পরেই তা দিয়ে তৈরি হয় গয়না ও ঘর সাজানোর নানা সামগ্রী। ঘরে ফেরার পথে এই ঝিনুক সংগ্রহ করাই তাঁদের আর-এক পেশা, জল সেঁচে ঝিনুক স্তূপ করতে করতে উপুড় করে দিল তাঁদের সেই রোজনামচা।
সমুদ্রের আকর্ষণ কাটিয়ে পর দিন বাবা ভূশণ্ডেশ্বর শিবলিঙ্গর দর্শনে এগিয়ে চললাম। এটিকে এশিয়ার সবচেয়ে বড় শিবলিঙ্গ বলে দাবি করেন স্থানীয়রা। তাঁদের বিশ্বাস, ত্রেতা যুগে লঙ্কার রাজা রাবণ মহাদেবের কাছ থেকে উপহার হিসেবে এই শিবলিঙ্গটি পান। এই শিবলিঙ্গটি আবার দেবী পার্বতী পুজো করতেন। কিন্তু রাবণকে যখন তাঁর পুষ্পক রথে করে এই শিবলিঙ্গটি নিয়ে চলে যেতে দেখেন, তখন ক্ষুব্ধ হন দেবতারা এবং ঠিক করেন এই শিবলিঙ্গ নিয়ে যাওয়া আটকাতে হবে। দেবতারা ওই শিবলিঙ্গ চাইলেও তা দিতে রাজি হন না রাবণ। টানাপড়েনে রাবণ তখন মাঝপথেই কোনও এক স্থানে ওই শিবলিঙ্গটি নামিয়ে রাখেন। পরে তা তুলতে গেলে শিবলিঙ্গটি এত ভারী হয়ে যায় যে, রাবণ তুলতে পারেন না। ফলে দীর্ঘদিন ওই শিবলিঙ্গটি রয়ে গিয়েছিল ওখানেই এবং বহু দিন বনের পশুরাই তা পাহারা দিয়েছিল। পরবর্তী কালে শিবলিঙ্গটি উদ্ধার করে মন্দির প্রতিষ্ঠা করা হয়।
এমন লৌকিক কথা শুনে ওখানে পৌঁছনোর পরে মনে লাগল খানিকটা বিষাদের ছোঁয়া। ভাঙাচোরা মন্দির। যত্ন যে তেমন নেই, তা দেখেই বোঝা যায়। কালো গ্রানাইট দিয়ে তৈরি ভূশণ্ডেশ্বর শিবলিঙ্গটির অর্ধেকটা রয়েছে মাটির তলায়। এলাকাবাসীদের আশ্বাস, প্রাচীন মন্দির ভেঙে পড়ায় নতুন মন্দির তৈরি করা হচ্ছে। বাবা ভোলানাথকে প্রণাম জানিয়ে এ বার ফেরার পালা।
আমরা ফিরছি তালসারি হয়ে দিঘার পথ ধরে। ফেরার পথে চোখ আটকে গেল একটা মাটির বাড়ির দাওয়ায়, মালসায় কালো কালো বস্তু দেখে গাড়ি থামালাম। কাছে গিয়ে দেখলাম, সূর্যমুখী ফুল থেকে কালো দানা ছাড়িয়ে রাখা রয়েছে পাত্রের মধ্যে। জানলাম, এখানেই সানফ্লাওয়ার অয়েলের আঁতুড়ঘর। ভারতে যে রাজ্যগুলি সানফ্লাওয়ার তেল উৎপাদনে প্রথম সারিতে, ওড়িশাও রয়েছে তাদের মধ্যে। সুখস্মৃতি সঙ্গে নিয়ে গাড়ি ঘোরালাম শহুের পথের দিকে।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy