মেঘের কাছাকাছি: অতন্দ্র প্রহরীর ন্যায় কুম্ভলগড়
মাথার উপরে ঝকঝকে নীল আকাশ। নীচে যত দূর চোখ যায়, কোথাও হালকা, কোথাও গাঢ় সবুজে ঢাকা আরাবল্লীর শাখা-প্রশাখা। তার ফাঁকে উঁকি মারে পদ্মকুঁড়ির নকশা করা এক প্রাচীরের প্রান্তভাগ। পাহাড়ের গা বেয়ে এঁকেবেঁকে, লুকোচুরি খেলতে খেলতে চলেছে পথ। ৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ প্রাচীরটিই পৃথিবীর দ্বিতীয় দীর্ঘতম প্রাচীর। এর আড়াআড়ি বিস্তারও তাক লাগিয়ে দেওয়ার মতো। আটটি ঘোড়া নাকি পাশাপাশি চলতে পারত এই প্রশস্ত প্রাচীরটির উপর দিয়ে। প্রাচীর ঘিরে রেখেছে এক আশ্চর্য সুন্দর দুর্গশহরকে। নাম তার কুম্ভলগড়। উদয়পুর থেকে ৮২ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে, মেবার ও মারোয়াড়ের সীমান্তে দুর্গটি তৈরি করেছিলেন রাণা কুম্ভ। চিতোরগড় বা জয়সলমেরের কেল্লার মতো খ্যাতি এর নেই। কিন্তু প্রকৃতি, ইতিহাস আর স্থাপত্য মিলেমিশে যে ঐশ্বর্যে ঋদ্ধ কুম্ভলগড়, তার আকর্ষণই বা কম কী! সেই টানেই উপস্থিত হয়েছি দুর্গদ্বারে।
সাত-সাতটি দরজা পেরিয়ে তবেই পৌঁছনো যায় কুম্ভলগড়ের প্রাসাদে। কারুকাজ করা পাথরের খিলানের মাঝে ভারী কাঠের দরজা, স্থানীয় ভাষায় বলা হয় ‘পোল’। দক্ষিণে অ্যারেত পোল পেরিয়ে কেল্লায় ওঠা শুরু। সেখান থেকেই প্রথম দর্শন মিলল কুম্ভলগড়ের। কালচে-হলুদ বেলেপাথরের দুর্গটি এক রোমাঞ্চকর মুগ্ধতায় মন ভরিয়ে দিল। হনুমান পোলের কাছে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে ঢুকলাম কেল্লার ভিতরে। অদূরে রাম পোল। প্রাচীরের গায়ের এই দরজাটিকে বলা যেতে পারে কেল্লার মূল প্রবেশদ্বার। দরজা পেরোলেই মনে হয় বুঝি এক লহমায় পিছিয়ে গেলাম কয়েকশো বছর। ৩৬০টি মন্দির, বেশ কিছু ঘরবাড়ি, পাথরে বাঁধানো উঁচু-নিচু রাস্তা, প্রাসাদ, মহল নিয়ে আরাবল্লীর কোলে ছড়িয়ে থাকা এই দুর্গ চত্বরের আনাচকানাচে ইতিহাস কথা বলে ওঠে। তখন নরম আলোয় ভেসে যাচ্ছে চার দিক। হেমন্তের শিরশিরে বাতাসে প্রকৃতির নিজস্ব সুগন্ধ, পথে ফুটে আছে থোকা থোকা করবী— এমন পরিবেশে খাড়া পথ বেয়ে হেঁটে ওঠার কষ্ট গায়ে লাগে না। রাম পোলের ডান দিকে অষ্টভুজাকৃতি, তিনতলা বেদী মন্দির দাঁড়িয়ে আছে একটি উঁচু বেদীর উপরে। পাশে নীলকণ্ঠের মন্দির। তার বিশাল গম্বুজ, ছাদ আর স্তম্ভ নজর কাড়ে। এখানকার প্রায় ছ’ফুট উঁচু শিবলিঙ্গটিকে নাকি নিয়মিত পুজো করতেন রাণা কুম্ভ। রাম পোলের বাঁ দিকে আছে গণেশ মন্দির যা সম্ভবত কুম্ভলগড়ের প্রাচীনতম।
গণেশ মন্দির থেকে সরু পথ উঠে গিয়েছে উপরে। তার শেষে ভৈরব পোল, পাগড়া পোল পেরিয়ে কুম্ভলগড়ের রাজপ্রাসাদ বাদলমহল। পাহাড়ের মাথায়, আকাশের গায়ে এই পাথরের প্রাসাদ ঘিরে সত্যিই মেঘেদের আনাগোনা। রাণা ফতেহ সিংহের তৈরি এই প্রাসাদ রাজপুত স্থাপত্যরীতিতে তৈরি। দোতলা প্রাসাদের দু’টি ভাগ— এক দিকে মহিলামহল, অন্য দিকে পুরুষদের, মাঝে প্রশস্ত চত্বর। জেনানা মহলের পাথরের দেওয়ালে অপূর্ব জালির কাজ। সেই ঝরোখার আড়াল থেকে রাজসভার কাজকর্ম দেখতেন রাজপুত রানিরা। দু’মহলেই রয়েছে বর্ণময় দেওয়াল চিত্র। এই কেল্লাতেই ১৫৪০ খ্রিষ্টাব্দে জন্ম হয় মহারাণা প্রতাপের। প্রাসাদসংলগ্ন যে ঘরে তিনি জন্মেছিলেন, সেটি নিতান্তই সাধারণ। স্বাধীনচেতা রাজপুত রাজার আড়ম্বরহীন জীবনের সঙ্গে ভারী মানানসই লাগল ঘরটিকে।
বাদলমহলের ছোট-বড় ঘর, অপ্রশস্ত সিঁড়ি, খিলানওয়ালা অলিন্দ পেরিয়ে পৌঁছলাম দোতলায়। খোলা জানালা দিয়ে নীচে তাকাতেই ভেসে উঠল গোটা কেল্লা ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের দিগন্তপ্রসারী বিস্তার। এক দিকে স্নিগ্ধ অরণ্যে ঢাকা মেবার, অন্য দিকে রুক্ষ মারোয়াড়। দূরে ফিকে হয়ে আসা পাহাড় পেরিয়ে মরুভূমির ধূসর আভাস। এই দৃশ্যমানতার কারণেই কেল্লাবাসীর নজর এড়িয়ে, অতর্কিতে দুর্গ আক্রমণ ছিল প্রায় অসম্ভব। তাই কুম্ভলগড় বারবার ফিরিয়ে দিতে পেরেছে শত্রুসৈন্যকে, বিপদের দিনে মেবারের রাজপরিবারকে দিয়েছে নিরাপদ আশ্রয়ের আশ্বাস। জাঁকজমক নয়, প্রতিরোধ ও অনমনীয়তাই ছিল কুম্ভলগড়ের আসল গর্ব। সেই গরিমার ইতিহাসকে সঙ্গী করে আজও দৃঢ়তায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রাণা কুম্ভের কেল্লা, অতন্দ্র প্রহরীর মতো।
Or
By continuing, you agree to our terms of use
and acknowledge our privacy policy
We will send you a One Time Password on this mobile number or email id
Or Continue with
By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy