Advertisement
২২ ডিসেম্বর ২০২৪
Travel and Tourism

আলগার্ভের আনাচকানাচে

পর্তুগাল মানে শুধু নীল-সবুজ সমুদ্রের হাতছানি নয়, পরতে পরতে জড়িয়ে রয়েছে আরও রোমাঞ্চ সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়াতে না গড়াতেই অতলান্তিকের নোনাধরা হাওয়ায় চারপাশ মোহময়ী হয়ে ওঠে।

অত্যাশ্চর্য: বেনাগিল কেভের বাইরে দেখলে তার ভিতরের আন্দাজ পাওয়া যায় না। রক ফর্মেশনের হাজারো নিদর্শন এর বিভিন্ন প্রান্তে

অত্যাশ্চর্য: বেনাগিল কেভের বাইরে দেখলে তার ভিতরের আন্দাজ পাওয়া যায় না। রক ফর্মেশনের হাজারো নিদর্শন এর বিভিন্ন প্রান্তে

দেবলীনা চট্টোপাধ্যায়
শেষ আপডেট: ১৩ মার্চ ২০২০ ০৩:২০
Share: Save:

ইদানীং মাঝেমাঝেই সূর্যের দেখা পাওয়া যাচ্ছে। গাছপালা সবুজ, ফুলের ভারে নুইয়ে পড়ছে। জুন মাস। গোটা ইউরোপ সামার ভেকেশনের আনন্দে আত্মহারা। এ সময়ে কি আর ঘরে বসে থাকা যায়! তাই প্ল্যানমাফিক পর্তুগালের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়লাম। বার্লিন থেকে উড়ানে পর্তুগাল। বাঙালির যেমন গোয়া, ব্রিটিশ-ইউরোপিয়ানদের তেমনই পর্তুগাল। ফারো এয়ারপোর্টে নামার সময় থেকেই সকলের প্রচণ্ড উৎসাহ— নীচে নীল-সবুজ অতলান্তিক দেখা যাচ্ছে। পর্তুগালের বিখ্যাত বিচ ফারো ও আলবুফেইরা। দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তকে সম্মিলিত ভাবে বলা হয় আলগার্ভে। ‘আলগার্ভ’ কথাটি আরবি শব্দ ‘আল-ঘারব’ থেকে, যার অর্থ পশ্চিম প্রান্ত।

প্রথম দিনটা রেখেছিলাম শহর দেখার জন্য। পাথুরে রাস্তা আর

মধ্যযুগের ছোট সুন্দর বাড়ি শহরের মূল রাস্তার দু’ধার জুড়ে। মাঝেমাঝেই এ দিক-ও দিক থেকে উঁকি মারছে অতলান্তিক। খাওয়াদাওয়া সেরে এগোলাম মেরিনার দিকে। পর্তুগালের সমুদ্রের জল ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন অনেক দিনের। মেরিনার দিকে যাওয়ার রাস্তা ওল্ড টাউনের মধ্য দিয়ে। ঐতিহাসিক টাউন যেন আলবুফেইরার মধ্যমণি। আঁকাবাঁকা টালি বসানো, আবার কখনও সুন্দর কালো পাথর বসানো রাস্তা ছড়িয়ে রয়েছে পুরো শহরে, এটাই পর্তুগিজ় স্টাইল।

আলবুফেইরার মূল আকর্ষণ, বিস্তৃত সমুদ্রসৈকত আর অসীম নীলচে-সবুজ জল। সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়াতে না গড়াতেই অতলান্তিকের নোনাধরা হাওয়ায় চারপাশ মোহময়ী হয়ে ওঠে। তবে যত গরম হোক না কেন, অতলান্তিকের জল সব সময়েই অল্পবিস্তর ঠান্ডা। মেরিনায় কিছু সময় কাটিয়ে সূর্য যখন অস্তাচলে, তখন আমরা উপরে উঠে এলাম। ওল্ড টাউন থেকে মেরিনা উতরাইয়ের পথ। তাই ফেরার সময়ে চড়াইয়ে একটু বেশি সময়ই লাগল। ফেরার পথে চোখে পড়বে দিগন্তবিস্তৃত সমুদ্রের জল আর উপরে রুপোলি চাদর বিছিয়ে দেওয়া পূর্ণিমার চাঁদ। সেই মায়াবী আলোয় প্রকৃতি উপভোগের জন্য রয়েছে কাঠের বেঞ্চ।

দ্বিতীয় দিন গেলাম বেনাগিল কেভ। এত দিন কম্পিউটারের ওয়ালপেপারে ছিল তার ছবি। মানুষের চোখের গঠনের মতো ফর্মেশনের জন্যই মূলত বিখ্যাত ‘আলগার দ্য বেনাগিল’। অদ্ভুত রক ফর্মেশনের জন্য এই বৃহদাকার কেভটিকে বাইরে থেকে দেখে মনে হয় ক্যাথিড্রাল। তাই অনেকে এটিকে ‘বেনাগিল ক্যাথিড্রাল’ও বলেন। প্রকৃতির অপার বিশালতা ও বিধ্বংসী ক্ষমতার কাছে সব কিছুই যে নশ্বর, তার প্রকৃত নিদর্শন এই বেনাগিল। বছরের পর বছর সমুদ্রের জল ও বাতাস পাথরকে ক্ষয় করে তৈরি করেছে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সি-কেভ! যদিও আসল রত্ন লুকিয়ে আছে কেভের মধ্যে। সমুদ্রের মধ্যে অবস্থিত হওয়ার জন্য প্রায়া-দি-মেরিনহা থেকে বেনাগিলের কাছাকাছি যেতে হয় বোটে চেপে। সেখান থেকে পর্যটকদের হয় স্পিডবোটে, নয় তো নিজেদের সিঙ্গল বা ডুয়েল স্ট্যান্ডআপ প্যাডলিং করে কেভের মধ্যে যেতে হয়।

এ দিনের পরবর্তী গন্তব্য ছিল লাগোস। নিজেদের গাড়িতেই গেলাম। লাগোসের মারিনা থেকে স্পিডবোট ছুটে চলল অতলান্তিকের বুক চিরে বেনাগিলের দিকে। পেরিয়ে গেলাম একের পর এক ছোট ছোট গ্রাম, বিশালাকার ক্লিফ আর আর্চ। সোনালি আর্চে সূর্যের আলো পড়ে গলন্ত সোনার মতোই ঝলমল করে! বেনাগিলের কাছাকাছি পৌঁছে, সুইম সুট ও লাইফ জ্যাকেট পরে তৈরি হয়ে নিলাম। বিশাল আকৃতির স্পিড বোটের মধ্য থেকে বেরিয়ে এল একের পর এক প্যাডল বোট। যাতে যাত্রীরা নিজেরাই প্যাডল করতে পারে বেনাগিলের ভিতরে। সাঁতার জানা থাকলে সিঙ্গল স্ট্যান্ডআপ প্যাডলিং বেশ উপভোগ্য।

বেনাগিলের ভিতরে পৌঁছে নিজের চোখকেই বিশ্বাস করতে পারছিলাম না! বহু দিনের স্বপ্ন সার্থক হলে মানুষ যেমন বাক্যহারা হয়ে যায়, তেমন অবস্থা। খেয়াল ছিল না যে, কায়াককে বিচে টেনে না তুললে তা ভেসে চলে যাবে সমুদ্রে। গাইডের কল্যাণেই সে যাত্রায় কায়াক উদ্ধার করা গেল। বেনাগিলের ভিতরে ঢুকে দেখি, এ যেন এক প্রাসাদ! দেওয়ালে অদ্ভুত ঘোরানো খাঁজ উঠে গিয়েছে মাথার দিকে আলগার পর্যন্ত। আলগার হল বেনাগিল কেভের মাথার গর্তটি। ভিতরের দেওয়ালটি সাদা, হলুদ এবং কমলা পাথরের সংমিশ্রণ। কেউ বলে না দিলে মনে হবে, আলাদা করে রং করা হয়েছে! কেভের ভিতরের বিচ ও সমুদ্রের জলের রং আরও একটি আকর্ষণ। ভিতরের জলের রং অদ্ভুত ভাবে নীল। আবার এই নীল জলই আমাদের নিয়ে গিয়ে ফেলে অতলান্তিকের সবুজ জলে।

তৃতীয় দিন ভোর থেকে শুরু হল বিচ হান্টিং। প্রথমেই প্রায়া-দে-সাও-রাফায়েল। আলবুফেইরার ওল্ড টাউন থেকে খুব কাছে এই বিচ। সাও রাফায়েল মূলত স্নান করার বিচ। উঁচু নিচু পাহাড়ের খাঁজের মধ্যে অদ্ভুত ভাবে লুকোনো। আর এর তিন দিক ঢাকা বিশালাকৃতির ক্লিফ দিয়ে। লাল, হলুদ, কমলা রঙের ছটায় চারপাশ উজ্জ্বল। তিন দিক ক্লিফ দিয়ে ঢাকা থাকায় অনেকটাই রেহাই মেলে হাওয়া আর বড় ঢেউয়ের হাত থেকে। এখানে কিছুক্ষণ বসে, জলে পা ভিজিয়ে, বেরিয়ে পড়লাম প্রায়া-দি-মারিনহার দিকে। গাড়ি থেকে নেমে আপ হাইক করে ক্লিফের উপরে উঠলে যে দৃশ্যের দেখা মেলে, তা সারা জীবনের সঙ্গী। ডান দিকে পর পর রক ফর্মেশন। কিছুটা দূরে বিখ্যাত ‘এম’ রক। ভাটার সময়ে বিচ দিয়ে হেঁটে ‘এম’ রকের নীচ পর্যন্ত পৌঁছনো যায়। প্রায়া-দি-মারিনহার বিচও সারা দিন কাটানোর জন্য আদর্শ। স্নরকেলিং ও ক্লিফ ওয়াকিংয়েরও সুবিধে আছে।

এ বার পাড়ি আলগার্ভের সবচেয়ে পশ্চিম প্রান্তে কেপ সেন্ট ভিনসেন্টের দিকে। এখানে দেখার মতো রয়েছে সাগ্রেস পয়েন্ট বা সাগ্রেস প্রণালী, লাইটহাউস কাবো সাও ভিনসেন্ট। সাগ্রেস পয়েন্ট থেকে যত দূরে দেখা যায়, চোখে পড়ে শুধু সমুদ্র। কথিত, কয়েকশো বছর আগে এখানেই হারিয়ে যায় একের পর এক জাহাজ। ২০০ ফুট ক্লিফের উপরে দাঁড়িয়ে অতলান্তিকের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে মনে হয়েছিল, সত্যিই পৃথিবীর শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছি!

হোটেলে ফিরে এসে শুনতে পাচ্ছিলাম নীচের ওল্ড টাউন থেকে ভেসে আসা হল্লা আর গানের সুর। আলবুফেইরা পার্টি টাউনই বটে। রাত প্রায় একটা, সবে যেন সন্ধে। কিন্তু সেই রোশনাইয়ের মাঝেও মন চলে যাচ্ছে সাগ্রেস পয়েন্টে। পৃথিবীর শেষ বলে সত্যিই যদি কিছু থেকে থাকে, তা হলে বোধহয় ওটাই। এমন অনেক ভাললাগা নিয়েই ঘুমিয়ে পড়ি।

অন্য বিষয়গুলি:

Travel and Tourism adventure Algarve Portugal
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের মাধ্যমগুলি:
Advertisement

Share this article

CLOSE

Log In / Create Account

We will send you a One Time Password on this mobile number or email id

Or Continue with

By proceeding you agree with our Terms of service & Privacy Policy